রাজনীতি ডেস্ক
২০২৪ সালের আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) মোট ৩৩৬ জনের মুক্তিযোদ্ধা গেজেট বাতিলের সুপারিশ করেছে। এসব সুপারিশের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে অনেক ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। একই সময়ে যাচাই-বাছাই ও শুনানি শেষে ৮৪ জনকে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ২৮ জনকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে গেজেটভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
জামুকা সূত্রে জানা যায়, বাতিলের সুপারিশপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নাম বেসামরিক, ভারতীয় তালিকা, লাল মুক্তিবার্তা, আনসার বাহিনী, সেনাবাহিনী এবং শহীদ পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন গেজেটে অন্তর্ভুক্ত ছিল। যাচাই প্রক্রিয়ায় এসব তালিকার তথ্য, অভিযোগ, মামলার রায়, সংশোধনী আবেদন এবং আপিল শুনানির নথি পর্যালোচনা করা হয়। যাচাই শেষে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অপ্রমাণিত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
২০২০ সালে নেওয়া এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারতীয় তালিকা ও লাল মুক্তিবার্তায় অন্তর্ভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ের আওতার বাইরে রাখার কথা ছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর জামুকার শুনানি ও যাচাই কার্যক্রমে এসব তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যেও অনিয়ম ও অসংগতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফলে ভারতীয় তালিকা ও লাল মুক্তিবার্তা থেকেও একাধিক ব্যক্তির নাম বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
গত বছরের ২৪ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সভাপতিত্বে জামুকার ৯১তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর এ পর্যন্ত মোট ১১টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব সভায় ৩৩৬ জনের গেজেট বাতিলের সুপারিশের পাশাপাশি বিভিন্ন বাহিনীতে নতুন করে অন্তর্ভুক্তি ও শ্রেণি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ৪৭ জন, শহীদ পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ৬ জন এবং সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ১ জনের গেজেটভুক্তির সুপারিশ রয়েছে। পাশাপাশি বাহিনী থেকে বেসামরিক, বেসামরিক থেকে পুলিশ, আনসার থেকে শহীদ আনসার এবং বেসামরিক থেকে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসেবে শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য ১৬ জনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে।
চলতি বছরের ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত জামুকার ১০০তম সভায় এককভাবে ১৭৫ জনের গেজেট বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ১০১তম সভায় দেশের বিভিন্ন জেলার অন্তত ৭১ জনের বেসামরিক, ভারতীয়, লাল মুক্তিবার্তা, আনসার বাহিনী, সেনাবাহিনী ও শহীদ পুলিশ বাহিনীর গেজেট বাতিলের সুপারিশ করা হয়। এই দুই সভার সিদ্ধান্তের পর ভারতীয় তালিকা ও লাল মুক্তিবার্তা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ পড়ার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়।
ভারতীয় তালিকা মূলত ১৯৭১ সালে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের নিয়ে প্রণীত। জামুকার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একাধিক ভারতীয় তালিকা বিদ্যমান। প্রথম তালিকাটি নির্ভরযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হলেও পরবর্তী সময়ে তৈরি হওয়া তালিকাগুলোর মধ্যে তথ্যগত অসঙ্গতি রয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ে অন্তত পাঁচ ধরনের ভারতীয় তালিকার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যার মধ্যে রয়েছে ভারতীয় তালিকা (সেনা, নৌ ও বিমান), ভারতীয় তালিকা (সেক্টর), ভারতীয় তালিকা মেঘনা এবং ভারতীয় তালিকা পদ্মা। সাম্প্রতিক শুনানিতে এসব তালিকা থেকে একাধিক ব্যক্তির নাম বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
এদিকে চলতি বছরের জুনে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধন করে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনে অন্তর্বর্তী সরকার। সংশোধিত সংজ্ঞা অনুযায়ী সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধকারী ব্যক্তিরা, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সংশ্লিষ্টরা, নির্যাতিত নারী (বীরাঙ্গনা) এবং মুক্তিযুদ্ধকালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া ফিল্ড হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবেন। পূর্ববর্তী আইনে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত হলেও নতুন অধ্যাদেশে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত এমএনএ ও এমপিএ, বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখা ব্যক্তি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলী, দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এবং স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যদের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে আলাদা শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যে জামুকা জানিয়েছে, যাচাই-বাছাই, শুনানি ও আপিল নিষ্পত্তির মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ২৮ জনকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে প্রমাণিত করা হয়েছে। তাঁদের গেজেটভুক্ত করার জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোগীদের তালিকা আরও সুনির্ভুল ও স্বচ্ছ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।