আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী ওডেসাকে কেন্দ্র করে রাশিয়া সাম্প্রতিক সময়ে হামলা উল্লেখযোগ্যভাবে জোরদার করেছে। ধারাবাহিক এসব হামলায় ওডেসা অঞ্চলে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাট সৃষ্টি হয়েছে, একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক অবকাঠামো ও বাণিজ্যিক নৌপরিবহন ব্যবস্থার ওপর গুরুতর চাপ তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে বলে জানিয়েছেন ইউক্রেনের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
ইউক্রেনের উপপ্রধানমন্ত্রী ও অবকাঠামো বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওলেক্সি কুলেবা জানিয়েছেন, রাশিয়া ওডেসা অঞ্চলে পরিকল্পিত ও পদ্ধতিগত হামলা চালাচ্ছে। গত সপ্তাহে দেওয়া এক বক্তব্যে তিনি সতর্ক করেন, যুদ্ধের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ধীরে ধীরে ওডেসার দিকে সরে আসতে পারে। তাঁর ভাষায়, রাশিয়ার লক্ষ্য কেবল সামরিক স্থাপনা নয়, বরং বিদ্যুৎ, বন্দর ও পরিবহন অবকাঠামোকে অকার্যকর করে দেওয়া।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, এই ধারাবাহিক হামলার মূল উদ্দেশ্য হলো ইউক্রেনকে আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক লজিস্টিকস এবং বাণিজ্যিক নৌপথ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। তিনি জানান, কৃষ্ণসাগরভিত্তিক বন্দরগুলো ইউক্রেনের অর্থনীতি ও খাদ্য রপ্তানির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর এসব স্থাপনায় আঘাত হানার মাধ্যমে দেশটির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে মস্কো।
চলতি ডিসেম্বরের শুরুতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সতর্কবার্তা দেন যে, কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার তথাকথিত ‘শ্যাডো ফ্লিট’-এর ট্যাংকারে ড্রোন হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইউক্রেনের সমুদ্রপথে প্রবেশাধিকার সীমিত বা বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে। ‘শ্যাডো ফ্লিট’ বলতে রাশিয়ার এমন শত শত ট্যাংকারকে বোঝানো হয়, যেগুলো ২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের পর আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল পরিবহনে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সর্বশেষ সোমবার সন্ধ্যায় ওডেসার বন্দর অবকাঠামো লক্ষ্য করে নতুন হামলা চালানো হয়। ওডেসা অঞ্চলের গভর্নর জানান, এতে একটি বেসামরিক জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই হামলাটি সাম্প্রতিক কয়েক দিনে চালানো শতাধিক হামলার অংশ, যার ফলে অঞ্চলজুড়ে দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে এবং একাধিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
এর আগের রাতে চালানো হামলায় প্রায় এক লাখ ২০ হাজার মানুষ বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। একই সময় একটি প্রধান বন্দরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, যেখানে ময়দা ও ভোজ্যতেলের ডজনখানেক কনটেইনার পুড়ে যায়। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানায়, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লেগেছে এবং এতে বন্দর কার্যক্রম সাময়িকভাবে ব্যাহত হয়।
গত সপ্তাহে ওডেসার পূর্বে অবস্থিত পিভদেননি বন্দরে একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় আটজন নিহত এবং অন্তত ৩০ জন আহত হন। নিহতদের মধ্যে বন্দর সংশ্লিষ্ট কর্মী ও বেসামরিক নাগরিক ছিলেন বলে জানানো হয়েছে। ওই হামলায় বন্দর অবকাঠামোর একটি অংশ গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে পণ্য খালাস ও পরিবহন কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে আরেকটি হামলায় তিন সন্তানসহ গাড়িতে ভ্রমণরত এক নারী নিহত হন। একই সঙ্গে সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ওডেসা অঞ্চলের সঙ্গে ইউক্রেন ও প্রতিবেশী মলদোভাকে সংযুক্তকারী একমাত্র সেতু। এই সেতু দিয়ে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন হয়ে থাকে, যা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সীমান্তবর্তী এলাকায় যোগাযোগে সমস্যা সৃষ্টি হয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ওডেসাকে লক্ষ্য করে হামলা জোরদার হলে ইউক্রেনের অর্থনীতি ও রপ্তানি ব্যবস্থার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে। কৃষ্ণসাগর উপকূলের এই অঞ্চলটি ইউক্রেনের অন্যতম প্রধান সমুদ্রবন্দর কেন্দ্র, যেখান দিয়ে শস্য, তেলজাত পণ্য ও অন্যান্য বাণিজ্যিক পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। বন্দর ও বিদ্যুৎ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উভয়ই বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ওডেসা ও আশপাশের অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার ও জরুরি মেরামত কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করছে ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ। তবে চলমান হামলার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুদ্ধার করা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।