নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও শহিদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও বিচার সম্পন্ন হয়নি। তিনি অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক বয়ান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে একটি নির্দিষ্ট পক্ষকে দায়ী করার প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চালানো হচ্ছে। রোববার (১৪ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানীর কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে জামায়াতের ঢাকা উত্তর মহানগর আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব বক্তব্য দেন।
আলোচনা সভায় অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, বুদ্ধিজীবীরা জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ছিলেন এবং তাদের হত্যাকাণ্ড স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার একটি বড় ঘটনা। তার বক্তব্যে ১৯৭১ সালের যুদ্ধপরবর্তী বাস্তবতা, আঞ্চলিক রাজনীতি এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রসঙ্গ উঠে আসে। তিনি দাবি করেন, ওই সময়ের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও আত্মনির্ভরশীলতা ঠেকানোর উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়।
তিনি আরও বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত নেপথ্য কারণ ও দায় নিরূপণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। তার মতে, তদন্ত ও বিচার না হওয়ায় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে এবং রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন ব্যাখ্যা সামনে আনা হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন ও দায়ীদের শনাক্ত করতে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি উল্লেখ করেন।
আলোচনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়ার প্রসঙ্গও উঠে আসে। অধ্যাপক পরওয়ার দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন ও যুদ্ধ-পরবর্তী কিছু ঘটনার বিষয়ে তথ্য থাকার কারণেই তাকে গুম করা হয়েছিল। তিনি বলেন, এসব ঘটনাও স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, অথচ সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আজও অনুপস্থিত।
সভায় দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গেও বক্তব্য দেন জামায়াতের এ নেতা। তিনি অভিযোগ করেন, গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতাকে কাজে লাগিয়ে একটি মহল দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। তার বক্তব্যে রাজনৈতিক বয়ান, ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস এবং সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার প্রসঙ্গ উঠে আসে। তিনি বলেন, এসব ঘটনার দায় সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা জরুরি।
অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার তার বক্তব্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রসঙ্গও আনেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক রীতিনীতি অনুসরণ করে পারস্পরিক সম্পর্ক পরিচালনা করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে তিনি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আইনসম্মত ও স্বচ্ছ অবস্থানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এই আলোচনা সভায় দলীয় নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় বক্তারা বুদ্ধিজীবীদের অবদান স্মরণ করেন এবং স্বাধীনতার ইতিহাসে তাদের হত্যাকাণ্ডের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন। বক্তৃতায় বারবার উঠে আসে বিচারহীনতার প্রসঙ্গ এবং ইতিহাসের বিতর্কিত অধ্যায়গুলো নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গবেষণা ও নথিভুক্তির প্রয়োজনীয়তা।
বাংলাদেশে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর পালিত হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, লেখক ও সংস্কৃতিজনদের হত্যা করা হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, এ হত্যাকাণ্ড স্বাধীনতার প্রাক্কালে জাতির মেধাশক্তিকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে তদন্ত ও বিচার সংক্রান্ত আলোচনা হলেও আজ পর্যন্ত সব ঘটনার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি।
এই প্রেক্ষাপটে আলোচনা সভায় উত্থাপিত বক্তব্যগুলো নতুন করে বিচার, গবেষণা এবং ঐতিহাসিক সত্য উদঘাটনের দাবি সামনে নিয়ে এসেছে। বক্তারা বলেন, নিরপেক্ষ তদন্ত ও তথ্যভিত্তিক ইতিহাসচর্চা ছাড়া শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি প্রকৃত সম্মান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।