অর্থনীতি ডেস্ক
ব্যবসায়িক প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে দীর্ঘদিন সড়কভিত্তিক উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেওয়ার ফলে দেশের রেল ও নৌপথ পর্যাপ্ত গুরুত্ব পায়নি—এমন মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি সাশ্রয়ী ব্যয়, পরিবেশগত ভারসাম্য এবং বহুমাধ্যমভিত্তিক সংযোগ নিশ্চিত করতে যোগাযোগ খাতে কৌশলগত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।
রোববার (১৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সড়ক ভবনে আয়োজিত পরিবহন সেক্টরের জাতীয় সমন্বিত বহুমাধ্যমভিত্তিক মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে অংশীজনদের সভায় এসব বক্তব্য দেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা। সভার লক্ষ্য ছিল সড়ক, রেল ও নৌপথকে সমন্বিতভাবে উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের রূপরেখা নির্ধারণ।
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, গত কয়েক দশকে সড়ক অবকাঠামো সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও রেল ও নৌপথ তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। এর ফলে পরিবহন ব্যবস্থায় ব্যয় বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ এবং যানজটের মতো সমস্যাগুলো প্রকট হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, বহুমাধ্যমভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে পণ্য পরিবহন ব্যয় কমানো সম্ভব হবে এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পাবে, যা টেকসই উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
নদীপথের গুরুত্ব তুলে ধরে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, দেশের ভৌগোলিক বাস্তবতায় নৌপথ একটি স্বাভাবিক ও সম্ভাবনাময় যোগাযোগ মাধ্যম। তবে নদী দখল, ভরাট এবং অপরিকল্পিত স্থাপনার কারণে নৌপথের সক্ষমতা ক্রমশ কমছে। তিনি জানান, নদী দখল করা তুলনামূলক সহজ হলেও তা উদ্ধার করা জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সক্রিয়তা নৌপথ উন্নয়নের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করছে। এ অবস্থায় সড়ক, রেল ও নৌপথের সমন্বিত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
রেলওয়ে খাতের বর্তমান অবস্থার প্রসঙ্গ টেনে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, সরকারি খাতভুক্ত হওয়ায় রেলওয়েতে সড়ক খাতের মতো বাণিজ্যিক প্রণোদনা বা প্রতিযোগিতামূলক চাপ কার্যকরভাবে কাজ করে না। এর ফলে দীর্ঘ সময় ধরে রেলসেবার মান, সময়ানুবর্তিতা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। তিনি জানান, রেলপথ আধুনিকায়ন ও পরিচালন দক্ষতা বাড়াতে নীতিগত সংস্কার, বিনিয়োগ কাঠামোর পরিবর্তন এবং প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা জরুরি।
সভায় পরিবহন খাতের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে বলা হয়, জাতীয় সমন্বিত বহুমাধ্যমভিত্তিক মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতি আসবে। শিল্পাঞ্চল, বন্দর, কৃষি উৎপাদন কেন্দ্র এবং ভোক্তা বাজারের মধ্যে সংযোগ জোরদার হবে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা মত দেন।
অংশীজনরা আরও জানান, সড়কনির্ভর পরিবহন ব্যবস্থার কারণে জ্বালানি আমদানির ওপর চাপ বাড়ছে এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেশি। রেল ও নৌপথের ব্যবহার বাড়ানো গেলে দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি সাশ্রয়, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং নিরাপদ পরিবহন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এ জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নের পাশাপাশি বাস্তবায়ন পর্যায়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়, অর্থায়ন নিশ্চিতকরণ এবং নিয়মিত তদারকির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ এবং অংশীজনরা উপস্থিত ছিলেন। তারা মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন এবং স্থানীয় বাস্তবতার প্রতিফলনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
সংশ্লিষ্টরা আশা প্রকাশ করেন, প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সুষম, কার্যকর ও টেকসই হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনজীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।