আন্তর্জাতিক ডেস্ক
হোয়াইট হাউস থেকে ডিসেম্বর মাসে দেওয়া এক ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, গত ১১ মাসে তার প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে যেকোনো সরকারের তুলনায় ‘আরো ইতিবাচক পরিবর্তন’ এনেছে। ভাষণে তিনি বলেন, “এমন কিছু আগে কখনো হয়নি।” তিনি আরো যোগ করেন, “এমনটা আগে কখনো ঘটেনি।” প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি নিজের প্রশাসনের সাফল্যকে অভূতপূর্ব বলে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তবে ২০২৫ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ৭৯ বছর বয়সী এই নেতা বিভিন্ন সময়ে যে ধরনের আচরণ করেছেন, তা নিয়ে দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গন, প্রশাসনিক মহল এবং সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে বিস্তর আলোচনা–সমালোচনা তৈরি হয়েছে। এসব আচরণের অনেক উদাহরণই তার মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ভূমিকা রেখেছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ট্রাম্পের শাসনামলে বিভিন্ন বৈঠক, আন্তর্জাতিক আলোচনার টেবিল এবং আনুষ্ঠানিক কর্মসূচিতে তার আচরণে অসংলগ্নতা, মনোযোগের ঘাটতি এবং বিষয়বিচ্যুতির একাধিক ঘটনা সংবাদে এসেছে। হোয়াইট হাউসের ভেতরকার বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী বৈঠক এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় প্রেসিডেন্টকে একাধিকবার ঘুমিয়ে পড়তে দেখা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়। শুধু ওভাল অফিসেই নয়, ডিসেম্বরে ক্যাবিনেট বৈঠক, গাঁজা সংস্কার নিয়ে সংবাদ সম্মেলন এবং নীতিনির্ধারণী বৈঠকেও তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বৈঠকগুলোতে ঘুমিয়ে পড়ার ঘটনা তার মানসিক চাপ, ক্লান্তি নাকি শারীরিক অসুস্থতার কারণে ঘটছে—তা নিয়ে কোনো সরকারি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তবে এ ধরনের দৃশ্যমান ঘটনার পুনরাবৃত্তি জনমনে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
বৈঠকে শুধু ঘুমিয়ে পড়াই নয়, আলোচনার মাঝপথে হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে অপ্রাসঙ্গিক ও অদ্ভুত বিষয় উত্থাপন করাও তার আচরণের আরেকটি আলোচিত দিক। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেয়েনের সঙ্গে জুলাই মাসের শেষদিকে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে অভিবাসন নীতি নিয়ে কথা বলতে বলতে প্রেসিডেন্ট আচমকা ‘উইন্ডমিল’ বা বায়ুশক্তি টারবাইন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি টানা দুই মিনিট ধরে দাবি করেন, বায়ুশক্তি টারবাইন নাকি তিমিকে ‘পাগল’ করে দেয় এবং এগুলো ‘পাখি মেরে ফেলে’। বাস্তবে বায়ু টারবাইনে পাখির মৃত্যুর হার অন্যান্য গৃহস্থালি প্রাণী বা বৈদ্যুতিক অবকাঠামোর তুলনায় অনেক কম—এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে বিস্তর তথ্য–উপাত্ত রয়েছে। কিন্তু বৈঠকে এমন দাবির পক্ষে প্রেসিডেন্ট কোনো প্রমাণ দেননি, এমনকি আলোচ্যসূচিতেও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে মনগড়া ইতিহাস ও সময়গত অসংলগ্নতার উদাহরণও রয়েছে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি আরেক ভাষণে তিনি বলেন, তার প্রয়াত কাকা অধ্যাপক জন ট্রাম্প নাকি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) টেড কাজিনস্কিকে পড়িয়েছিলেন, যিনি ‘ইউনাবোম্বার’ নামে পরিচিত। তিনি বলেন, “আমি আঙ্কেল জনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেমন ছাত্র ছিল সে? তিনি বলেছিলেন, ‘খুব ভালো’।” প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, “সে নাকি সবার ভুল ঠিক করে দিত।” কিন্তু এই দাবির ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। অধ্যাপক জন ট্রাম্প ১৯৮৫ সালে মারা যান, আর ‘ইউনাবোম্বার’ হিসেবে কাজিনস্কিকে শনাক্ত করা হয় ১৯৯৬ সালে। তাছাড়া টেড কাজিনস্কি এমআইটিতে পড়াশোনা করেননি; তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ফলে প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্য সময়গত ও তথ্যগতভাবে ভুল, যা পরে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
সেপ্টেম্বর মাসে ভার্জিনিয়ায় শীর্ষ সামরিক কমান্ডারদের সঙ্গে বৈঠকে নিজের প্রশাসনের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট আবারো তার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্টদের সিঁড়ি দিয়ে নামার ভঙ্গি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। তিনি বলেন, “বাইডেনকে প্রতিদিন সিঁড়ি থেকে পড়ে যেতে দেখা যেত।” এরপর নিজের প্রসঙ্গে বলেন, “আমি খুব সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নামি, শুধু পড়ে যেও না।” বৈঠকে তিনি আরো বলেন, “কয়েকজন প্রেসিডেন্ট সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছেন, আর সেটাই তাদের উত্তরাধিকার হয়ে গেছে।” একই বক্তব্যে বারাক ওবামার সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামার ভঙ্গি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “ওবামার প্রতি আমার শূন্য সম্মান ছিল,” যদিও তিনি স্বীকার করেন, “ওবামা সেটা ভালোভাবেই করতেন।” রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আনুষ্ঠানিক নীতিনির্ধারণী বৈঠকে এমন ব্যক্তিগত ভঙ্গিমা নিয়ে আলোচনায় জড়িয়ে পড়া প্রেসিডেন্টের মনোযোগের ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।
বছরজুড়ে তার মানসিক সক্ষমতা নিয়ে ওঠা প্রশ্ন হোয়াইট হাউস বারবার নাকচ করেছে। প্রশাসনের মুখপাত্ররা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, প্রেসিডেন্টের ‘মানসিক তীক্ষ্ণতা অতুলনীয়’ এবং ‘তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ’। প্রেস ব্রিফিংয়ে সাবেক চিকিৎসক ও বর্তমানে কংগ্রেসম্যান রনি জ্যাকসন তাকে ‘দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সুস্থ প্রেসিডেন্ট’ বলেও মন্তব্য করেন। কিন্তু এসব প্রশাসনিক ভাষ্য জনমনে তৈরি হওয়া সংশয়ের পুরোপুরি অবসান ঘটাতে পারেনি।
নভেম্বরে ভার্জিনিয়ায় অনুষ্ঠিত এক ভাষণে শান্তিচুক্তি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি ‘আলবেনিয়া’ ও ‘আর্মেনিয়া’কে গুলিয়ে ফেলেন। অটিজম নিয়ে এক আলোচনায় তিনি বলেন, “কিছু প্রতিভার উপাদান শিশুর মধ্যে দেওয়া হতে পারে।” ১৩টি গবেষণা অনুদান ঘোষণার সময় তিনি বলেন, “কিছু খারাপ হতে পারে না, শুধু ভালোই হতে পারে,” যা নীতিগত আলোচনায় অতিসরলীকরণ হিসেবে সমালোচিত হয়। একই মাসে প্রেসিডেন্ট জানান, তিনি এমআরআই করিয়েছেন, কিন্তু কোন অঙ্গের এমআরআই করা হয়েছে তা স্মরণ করতে পারেননি, যা তার স্মৃতিশক্তি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি করে।
আচরণগত অসংলগ্নতার পাশাপাশি প্রকাশ্য বক্তব্যে বিতর্কিত শব্দচয়নও আলোচনায় এসেছে। ডিসেম্বর মাসে তিনি সোমালি অভিবাসীদের ‘আবর্জনা’ বলে মন্তব্য করেন এবং চলচ্চিত্র পরিচালক রব রেইনারকে নিজের মৃত্যুর জন্য দায়ী করার মতো বক্তব্য দেন, যা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
ডিজিটাল বিশ্লেষণ বলছে, তার দ্বিতীয় মেয়াদের ১১ মাসে কর্মসূচির দৈর্ঘ্য ও প্রকাশ্য উপস্থিতি কমেছে। একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের হিসাব অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের নির্ধারিত সময়সূচি সাধারণত দুপুরে শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৫টার মধ্যেই শেষ হয়, যা তার প্রথম মেয়াদের তুলনায় সংক্ষিপ্ত। আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি কমেছে প্রায় ৩৯ শতাংশ। প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রেসকে দেওয়া দৈনিক সূচিতে প্রেসিডেন্টের সব বৈঠক অন্তর্ভুক্ত থাকে না, ফলে প্রকৃত কর্মসূচি আরো ভিন্ন হতে পারে।
রাজনৈতিক মহলে ধারণা, আগামী মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিরোধী পক্ষ প্রেসিডেন্টের মানসিক সক্ষমতা ও বয়সকে বড় ইস্যু হিসেবে সামনে আনতে পারে, কারণ বছরজুড়ে তার বক্তব্য ও আচরণের ভুল–ত্রুটির উদাহরণ ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। জনমনে এই বিতর্কের স্থায়িত্ব কতদিন থাকবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দপ্তর ঘিরে তৈরি হওয়া মানসিক সক্ষমতা–বয়স–কর্মদক্ষতার ত্রিমাত্রিক এই আলোচনা ২০২৫ সালের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।