অনলাইন ডেস্ক

প্রবাসে অবস্থান করেও ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের লক্ষ্যে ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপে নিবন্ধন করছেন বাংলাদেশি নাগরিকরা। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) উদ্যোগে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনে বিদেশে থাকা নাগরিকদের জন্য পোস্টাল ভোটের ব্যবস্থা চালু হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে ব্যাপক নিবন্ধন কার্যক্রম। মালয়েশিয়া থেকে ইতোমধ্যে ৩৯ হাজার ৬৩৮ জন প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন, যা দেশভিত্তিক নিবন্ধন তালিকায় মালয়েশিয়াকে চতুর্থ অবস্থানে নিয়ে এসেছে। নিবন্ধন কার্যক্রম ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে।

বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় এটি একটি যুগান্তকারী সংযোজন। এর আগে বিদেশে থাকা নাগরিকরা দূরত্ব, প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা এবং নিবন্ধন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে জাতীয় নির্বাচনে সরাসরি অংশ নিতে পারতেন না। তবে নির্বাচন কমিশন বিশেষ অ্যাপ ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ চালুর মাধ্যমে এই প্রতিবন্ধকতা দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই অ্যাপে নিবন্ধনের মাধ্যমে প্রবাসীরা তাদের বৈধ ভোটার পরিচয়ের তথ্য আপলোড করে ব্যালট পেপার সংগ্রহ ও ডাকযোগে দেশে পাঠানোর মাধ্যমে ভোট প্রদান করতে পারবেন।

ইসির তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা বিশ্ব থেকে মোট নিবন্ধিত প্রবাসী ভোটারের সংখ্যা ৫ লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। এই বিপুল নিবন্ধন সংখ্যা প্রবাসী নাগরিকদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের আগ্রহের একটি স্পষ্ট প্রতিফলন।

মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত প্রবাসীদের নিবন্ধনের হার উল্লেখযোগ্য। দেশটি থেকে ৩৯ হাজার ৬৩৮ জন নিবন্ধন করেছেন, যার মধ্যে নারী ভোটার মাত্র ৪৮৫ জন। যদিও পুরুষ ভোটারের তুলনায় নারী ভোটারের সংখ্যা কম, তবে নির্বাচন কমিশন মনে করছে—নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজীকরণ, তথ্যপ্রযুক্তি সহায়তা বৃদ্ধি এবং সামাজিক সচেতনতার ফলে আগামীতে নারী ভোটারের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে।

মালয়েশিয়ায় নিবন্ধিত ভোটারের সংখ্যা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও ইসি স্বীকার করেছে, প্রবাসীদের মাঝে ভোট প্রক্রিয়া, ব্যালটের নিরাপদ পৌঁছানো এবং গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে কিছু সংশয় এখনও রয়ে গেছে।

প্রবাসী ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘ ১৭ বছর পর অনলাইনে ভোটার হওয়ার আবেদন করতে পেরে তারা উচ্ছ্বসিত। অনেকেই এটিকে প্রবাসীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা হিসেবে দেখছেন। তবে ভোট কিভাবে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে, ব্যালট সময়মতো পৌঁছাবে কিনা এবং ডাকযোগে দেশে পাঠানোর পর তা নিরাপদে সংরক্ষিত থাকবে কিনা—এসব বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।

কিছু ভোটার ব্যক্তিগত তথ্য ও ভোটের গোপনীয়তা রক্ষা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের আশঙ্কা, ভোট দেয়ার তথ্য সম্পূর্ণ গোপন থাকবে তো? তবে এসব সংশয়ের মাঝেও ভোট প্রদানের আগ্রহে ভাটা পড়েনি বলে জানান অধিকাংশ প্রবাসী।

মালয়েশিয়ায় নিবন্ধন কার্যক্রমে সাধারণ প্রবাসীদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন অনেক সচেতন নাগরিক। তারা প্রবাসীদের বাসা ও কর্মস্থলে গিয়ে নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য আপলোড, ফরম পূরণ এবং অ্যাপ ব্যবহারে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করছেন।

সহায়তাকারী প্রবাসীরা জানান, এটি তাদের স্বেচ্ছাসেবামূলক উদ্যোগ। তারা মনে করেন, গণতান্ত্রিক পরিবেশে নাগরিক অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রবাসীদের নিবন্ধনে সহযোগিতা করা জাতীয় দায়িত্বের অংশ।

নিবন্ধন সম্পন্ন হওয়ার পর প্রবাসী ভোটারদের দেয়া ঠিকানায় ব্যালট পেপার পাঠানোর কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। ইসি জানায়, নিবন্ধিত ভোটাররা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যালট পূরণ করে ডাকযোগে তা বাংলাদেশে পাঠাবেন। ডাক বিভাগ ও কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে এই ব্যালট দেশে পৌঁছানোর পর তা ইসির নির্ধারিত সংরক্ষণ ব্যবস্থায় জমা হবে এবং গণনার সময় বৈধ ভোট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

মালয়েশিয়া থেকে ৩৯ হাজারের বেশি নিবন্ধন ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক মাত্রা যোগ করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রবাসীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য; এবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের সরাসরি অংশগ্রহণ সেই অবদানকে আরও দৃশ্যমান করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

নির্বাচন কমিশন জানায়, নিবন্ধনের শেষ সময় ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হলেও ব্যালট পূরণ ও দেশে পাঠানোর জন্য আলাদা সময়সীমা নির্ধারণ করে শিগগিরই প্রবাসীদের জানিয়ে দেয়া হবে।

এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে ইসিকে একাধিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে—বিশেষত ব্যালটের আন্তর্জাতিক ডাকযোগে নিরাপদ পরিবহন, ভোটের গোপনীয়তা রক্ষা, তথ্য যাচাই, প্রবাসে নারী ভোটারের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং সময়মতো ব্যালট পৌঁছানোর নিশ্চয়তা প্রদান। এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন আশাবাদী, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা গেলে প্রবাসীদের পোস্টাল ভোট ব্যবস্থা ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোতেও স্থায়ী গণতান্ত্রিক অনুষঙ্গ হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, ভোটাধিকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার। প্রবাসে থাকা নাগরিকদের সেই অধিকার নিশ্চিত করতে পোস্টাল ভোট ব্যবস্থা চালু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে বিবেচিত হচ্ছে। আগামী নির্বাচনগুলোতে এই ব্যবস্থার সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলে প্রবাসীদের রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরও দৃঢ় ভূমিকা রাখবে—এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।