নিজস্ব প্রতিবেদক
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শেষ মেয়াদে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সদস্যরা শুল্ক ও করমুক্ত সুবিধায় যে বিলাসবহুল গাড়িগুলো আমদানি করেছিলেন, তার মধ্যে ৩০টি গাড়ি আজ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহন পুলে হস্তান্তর করা হচ্ছে। প্রায় ২৭০ কোটি টাকা মূল্যের এসব গাড়ি শর্তসাপেক্ষে সরকারের কাছে নেওয়া হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো আইনি বা প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি না হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ১২ নভেম্বর এক বিশেষ আদেশের মাধ্যমে গাড়িগুলো পরিবহন পুলে দেওয়ার অনুমোদন দেয়। আদেশ অনুযায়ী, ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক অর্থাৎ সাবেক সংসদ সদস্যরা চাইলে নির্ধারিত শুল্ক ও কর পরিশোধ করে এসব গাড়ি পুনরায় ফেরত নিতে পারবেন। আপাতত গাড়িগুলো সরকারি পরিবহন ব্যবস্থার কাজে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।
নিলামে প্রত্যাশিত দর না ওঠায় গত সেপ্টেম্বরে অন্তর্বর্তী সরকার দ্বাদশ সংসদের ৩১ জন সংসদ সদস্যের শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা মোট ৩১টি বিলাসবহুল গাড়ি পরিবহন পুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে একটি গাড়ির প্রক্রিয়া এখনো চূড়ান্ত না হলেও বাকি ৩০টির সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা গাড়ি এভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কোনো নজির না থাকায় বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনিক ও আইনগত জটিলতা তৈরি হয়।
এই জটিলতা নিরসনে যানবাহন অধিদপ্তর, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)-এর সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সুপারিশ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মতামতের ভিত্তিতে এনবিআর বিশেষ আদেশ জারি করে, যা এই হস্তান্তরের পথ সুগম করে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, আমদানির পর দীর্ঘদিন ধরে গাড়িগুলো বন্দরের শেডে সংরক্ষিত ছিল। এরইমধ্যে যানবাহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বন্দরে গিয়ে গাড়িগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করেন। সব যাচাই-বাছাই ও প্রক্রিয়া শেষে গাড়িগুলো পরিবহন পুলে হস্তান্তরের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার শরিফ আল আমিন বলেন, গাড়ি খালাসের জন্য প্রয়োজনীয় সব আনুষ্ঠানিকতা ইতোমধ্যে শেষ করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও পরিবহন পুল সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা গাড়িগুলো বুঝে নিতে বন্দরে উপস্থিত হয়েছেন।
গাড়ি আমদানিকারকদের মতে, এসব বিলাসবহুল গাড়ির মূল্য অত্যধিক হওয়ায় এবং নিলাম প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন জটিলতা থাকায় প্রত্যাশিত দর পাওয়া কঠিন ছিল। দীর্ঘদিন বন্দরের শেডে পড়ে থাকলে গাড়িগুলোর ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ত। সে বিবেচনায় নিলামের পরিবর্তে পরিবহন পুলে দেওয়াকেই তারা বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন।
তবে বিষয়টি ঘিরে সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির বিদ্যমান আইনের সংশোধনের দাবি উঠেছে। বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা) মনে করছে, বর্তমান বিধান সময়োপযোগী নয় এবং এতে নীতিগত অস্পষ্টতা রয়েছে।
বারভিডার সাবেক সহ-সভাপতি মো. হাবিবুর রহমান বলেন, সংসদ সদস্যদের জন্য যদি শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি দেওয়া হয়, তাহলে ইঞ্জিন ক্ষমতা ও ব্যবহারিক দিক বিবেচনায় স্পষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। তাঁর মতে, কোন ধরনের গাড়ি, কী পরিমাণ ইঞ্জিন ক্ষমতা এবং কী শর্তে সুবিধা দেওয়া হবে—এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কাঠামো না থাকায় ভবিষ্যতে আবারও জটিলতা দেখা দিতে পারে।
উল্লেখ্য, সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানির বিধান চালু হয় এরশাদ সরকারের আমলে। দ্বাদশ সংসদের মেয়াদে এ সুবিধায় মোট ৫১টি গাড়ি আমদানি করা হলেও সংসদ বিলুপ্তির পর অধিকাংশ গাড়িই খালাস করা সম্ভব হয়নি। এসব গাড়ির বড় একটি অংশ টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার ব্র্যান্ডের।
বর্তমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় সম্পদের সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে চাচ্ছে, অন্যদিকে ভবিষ্যতে সাবেক সংসদ সদস্যদের আইনি অধিকারও সংরক্ষিত রাখছে। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, এই সিদ্ধান্ত সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত সুবিধা সংক্রান্ত নীতিমালা পুনর্বিবেচনার আলোচনাকে আরও জোরালো করবে।