নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, দেশের যুবসমাজকে বেকারভাতা প্রদানের পরিবর্তে প্রত্যেকের হাতে কাজ তুলে দেওয়াই তাদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) দুপুরে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এ কথা জানান। তিনি বলেন, সংখ্যার হিসাব কষে কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি এবং বাকি যুবকদের জন্য ভাতার পরিকল্পনা জামায়াতে ইসলামী সমর্থন করে না; বরং তারা প্রতিটি যুবকের কর্মদক্ষতা কাজে লাগিয়ে দেশ গঠনে তাদের সরাসরি সম্পৃক্ত করতে চায়।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলনটি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সারাদেশ থেকে সংগঠনটির নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অংশ নেন। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং উদ্বোধনী বক্তব্যের পর মূল আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন জামায়াত আমির। তিনি তার বক্তৃতায় কর্মসংস্থান, শিক্ষা সংস্কার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং যুবসমাজের সম্ভাবনা—এসব ইস্যুতে দলের ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “অনেকে সংখ্যা গুনে বলছেন—এত কোটি, এত লাখ যুবককে কর্মসংস্থান দেবেন। আর বাকিদের জন্য ভাতা দেবেন। কিন্তু আমরা চাই না আমাদের যুবকরা কারও কাছ থেকে বেকারভাতা গ্রহণ করুক। আমরা প্রতিটি যুবকের হাতকে দেশ গড়ার হাতে পরিণত করতে চাই। বেকারভাতা নয়, বেকারভাতার পরিবর্তে যুবকরাই দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করবে।” তিনি স্পষ্ট করে বলেন, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে যুবকদের জন্য ভাতানির্ভরতা তৈরি না করে কর্মনির্ভর আত্মমর্যাদাশীল জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা।
তার বক্তব্যে ‘বিপ্লব’ শব্দটি বারবার উঠে আসে, তবে তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তরের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি বলেন, “বিপ্লবের বাণী তাদের মুখে পৌঁছে দিতে চাই, শক্তি তাদের বুকে তুলে দিতে চাই আর তাদের হাতে কাজ তুলে দিতে চাই। তোমরা তৈরি হও, ইনশা আল্লাহ তোমরা পারবা। আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি।” এ সময় তিনি তরুণ নেতৃত্বকে আত্মবিশ্বাস, ঐক্য এবং প্রস্তুতির ওপর গুরুত্ব দেন।
শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের প্রসঙ্গেও কথা বলেন জামায়াত আমির। তিনি জানান, এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা তারা আয়োজন করতে চান, যা শিক্ষার্থীদের নৈতিক, মানবিক ও কারিগরি দক্ষতায় পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। তিনি বলেন, “এমন শিক্ষা চাই, যা তোমাদের মানুষের মতো মানুষ হতে সাহায্য করবে, তোমাদের শিক্ষার চরম উৎকর্ষে পৌঁছে দেবে। সেই শিক্ষা নিয়ে, উন্নত চরিত্র নিয়ে, দক্ষ কারিগর হয়ে তোমরা সমাজগঠনে আত্মনিয়োগ করবে। আমাদের লক্ষ্য—দেশে একজন যুবক বা যুবতীও বেকার থাকবে না।” তার মতে, নৈতিক চরিত্র ও কারিগরি দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসংস্থানের ভিত্তি শক্তিশালী করতে পারে।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের বিজয়ের প্রসঙ্গ স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “তোমাদের কাঁধে ১৮ কোটি মানুষের বোঝা। আল্লাহ এই বোঝা তোমাদের জন্য হালকা করে দিন এবং তা বহনের শক্তি দান করুন। ছাত্রসমাজ তোমাদের ভোট দিয়েছে, কারণ তারা তোমাদের ইনসাফের প্রতীক হিসেবে দেখতে চায়, অন্য কোনো কারণ নেই।” তিনি এই বিজয়কে তরুণদের প্রতি জনআস্থার প্রতিফলন এবং ভবিষ্যতে ন্যায়ভিত্তিক নেতৃত্বের ইঙ্গিত হিসেবে উল্লেখ করেন।
ন্যায়বিচার বা ‘ইনসাফ’ প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে ন্যায়বিচারের বড় ঘাটতি রয়েছে এবং এই ন্যায়বিচারের ভিত্তি হতে হবে কোরআন ও সুন্নাহ। তিনি বলেন, “কোরআন–সুন্নাহ বাদ দিয়ে দুনিয়ার কোথাও ইনসাফ কায়েম হয়নি, হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। এ ব্যাপারে আমরা ডেসপারেট—কারণ আজ বাংলাদেশে ইনসাফের বড় অভাব।” তার মতে, কোরআন–সুন্নাহভিত্তিক সামাজিক শৃঙ্খলা শান্তি ও ন্যায় নিশ্চিত করার একটি কার্যকর কাঠামো হতে পারে।
রাজনৈতিক বক্তব্যে দুর্নীতি ও বৈষম্য দূরীকরণের অঙ্গীকারও করেন তিনি। তার ভাষ্য, “আল্লাহর দেওয়া বিধান অনুযায়ী মানুষের জীবনে শান্তি–শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা একটি দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত ও ইনসাফভিত্তিক মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই।” তিনি বলেন, এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নৈতিক সংস্কার এবং দক্ষ জনশক্তির সমন্বয় প্রয়োজন।
সম্মেলনে উপস্থিত তরুণ প্রতিনিধিদের উদ্দেশে তিনি শিক্ষা, কর্ম ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান। বক্তব্যের বিভিন্ন পর্যায়ে তার ভাষায় আশাবাদের পাশাপাশি কর্ম–অঙ্গীকারের দৃঢ়তা লক্ষ করা যায়। তিনি জোর দেন যে, যুবসমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রকে ভাতানির্ভরতা নয়, দক্ষতা–কর্মসংস্থানকেন্দ্রিক পরিকল্পনায় এগোতে হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে উচ্চ যুব বেকারত্বের প্রেক্ষাপটে কর্মসংস্থান–কেন্দ্রিক রাজনৈতিক বার্তা তরুণ ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম, বিশেষত যখন তা আত্মমর্যাদা, দক্ষতা উন্নয়ন এবং রাষ্ট্র–গঠনে অংশগ্রহণের মতো উপাদানের সঙ্গে যুক্ত হয়। তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নীতিকাঠামো, বিনিয়োগ, শিল্প–চাহিদা, দক্ষতা–প্রশিক্ষণ, উদ্যোক্তা–সহায়তা এবং শ্রম–বাজারের সক্ষমতার ওপর এসব প্রতিশ্রুতির কার্যকারিতা নির্ভর করবে।
সম্মেলনের সমাপনী পর্বে দলের অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতারাও বক্তব্য দেন এবং সংগঠনের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়। জামায়াত আমিরের ভাষ্য অনুযায়ী, যুবসমাজকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর এবং ন্যায়–শৃঙ্খলাভিত্তিক রাষ্ট্র–ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই আগামী দিনে তাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকৌশলের প্রধান দিক হিসেবে বিবেচিত হবে।