নিজস্ব প্রতিবেদক
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অঙ্গনে জোট ও আসন সমঝোতা নিয়ে তৎপরতা বাড়ছে। সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে বড় দলগুলোর পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত ছোট ও নতুন দলগুলোও সমমনা শক্তির সঙ্গে জোট গঠন বা নির্বাচনী সমঝোতার পথে হাঁটছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর সম্ভাব্য জোট বা আসন সমঝোতা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা ও বিতর্ক তীব্র আকার ধারণ করেছে।
জামায়াত ও এনসিপি সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, দল দুটির মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা চূড়ান্ত হওয়ার পথে রয়েছে। আজ রোববার (২৮ ডিসেম্বর) এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও বিস্তারিত ঘোষণা আসতে পারে। সম্ভাব্য জোটের আওতায় কোন আসনে কোন দল প্রার্থী দেবে, কোন দলের কতজন প্রার্থী থাকবেন এবং যৌথভাবে কীভাবে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালিত হবে—এসব বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে।
সূত্রগুলো জানায়, আসন সমঝোতার অংশ হিসেবে জামায়াত এনসিপির জন্য অন্তত ২০টি সংসদীয় আসন ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব বিবেচনায় রয়েছে। সম্ভাব্য তালিকায় এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার, ড. আতিক মুজাহিদ, দক্ষিণ অঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এবং সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদসহ একাধিক নেতার নাম আলোচনায় রয়েছে।
তবে জামায়াতের সঙ্গে সম্ভাব্য জোট নিয়ে এনসিপির ভেতরে স্পষ্ট বিভাজন তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটির একটি বড় অংশ সমঝোতার পক্ষে থাকলেও, আরেকটি অংশ এ ধরনের জোটে যেতে অনাগ্রহী। এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসার পর বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে।
জোট আলোচনা শুরুর পরপরই এনসিপিতে পদত্যাগের ঘটনাও ঘটেছে। গত ২৫ ডিসেম্বর দলটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব ও নির্বাহী কাউন্সিল সদস্য মীর আরশাদুল হক পদত্যাগ করেন। তিনি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এনসিপির মনোনয়ন পেলেও নির্বাচনে অংশ নেবেন না বলে জানান। এরপর ২৭ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা। তার সঙ্গে একমত পোষণ করে জামায়াতের সঙ্গে জোটের বিরোধিতা করেন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, জ্যেষ্ঠ সদস্য সচিব নাহিদ সারোয়ার নিভা, যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনুভা জাবীন ও যুগ্ম সদস্য সচিব নুসরাত তাবাসসুমসহ আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।
এছাড়া জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিক জোট বা আসন সমঝোতার বিরোধিতা জানিয়ে গত শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) এনসিপির ৩০ জন নেতা আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে লিখিত চিঠি দেন। চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ, যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন, কেন্দ্রীয় সংগঠক আরমান হোসাইন, যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক খান মো. মুরসালীন ও সংগঠক রফিকুল ইসলাম আইনীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা রয়েছেন।
এর বিপরীতে একই দিনে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির ১৭০ জন নেতা জামায়াতের সঙ্গে জোট বা সমঝোতার পক্ষে অবস্থান জানিয়ে আহ্বায়ককে চিঠি দেন। চিঠিদাতাদের মধ্যে সারোয়ার তুষার, ড. আতিক মুজাহিদ, আরিফুল ইসলাম আদীব, জাভেদ রাসীন, আরিফুর রহমান তুহিন, সাইফুল্লাহ হায়দার ও আলাউদ্দিন মোহাম্মদসহ একাধিক নেতা রয়েছেন।
এনসিপির অবস্থান ব্যাখ্যা করে দলের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক বার্তায় সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ঐকমত্য কমিশনে সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে অন্যান্য দলগুলোর মতভিন্নতা দেখা গেছে। তার মতে, সংস্কারসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে এনসিপি, জামায়াত ও অন্যান্য কয়েকটি দলের অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই কাছাকাছি এসেছে। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র সংস্কার, নতুনভাবে দেশের রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলার রাজনৈতিক অঙ্গীকারই নির্বাচনী জোট বা সমঝোতার ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এর আগে ২৫ ডিসেম্বর আখতার হোসেন জানান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচনী জোট, আসন সমঝোতা ও সংস্কার নিয়ে আলোচনা চলছে এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে পরবর্তী পদক্ষেপ জানানো হবে। একইভাবে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দিন মোহাম্মদ বলেন, সংস্কারপন্থি ও পরিবর্তনের পক্ষে থাকা দলগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়াকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের জানান, বিদ্যমান জোটের বাইরেও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে এবং এনসিপির সঙ্গেও এ ধরনের আলোচনা হয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।
সব মিলিয়ে, সম্ভাব্য জামায়াত–এনসিপি জোট একদিকে যেমন নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করতে পারে, অন্যদিকে এনসিপির ভেতরের বিভক্তি দলটির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশল ও নির্বাচনী প্রস্তুতিকে কীভাবে প্রভাবিত করবে—সেদিকে নজর রাখছে রাজনৈতিক মহল।