দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল মেলার ১৭তম দিন। মেলায় প্রতিদিন আসছে নতুন নতুন বই। ইতোমধ্যে সব প্রকাশকরা বাঁধাইয়ের কাজ শেষে নতুন বইগুলো স্টলে এনেছেন। সেইসঙ্গে ধুম লেগেছে বেচাকেনার। মেলায় আসা পাঠকদের কারো হাত খালি নেই। প্রায় সবাই হাতেই নতুন থাকে বইয়ের ব্যাগ। বিকেল থেকে শুরু হয় বেচাকেনা। সন্ধ্যায় ক্রেতাদের চাপে হাপিয়ে উঠেন বিক্রেতারা।
বাংলা একাডেমির তথ্যমতে, ইতোমধ্যে মেলায় এসেছে ২ হাজার ৬২২টি নতুন। এরইমধ্যে শুধু বাংলা একাডেমি এককভাবে বিক্রি করেছে ১ কোটি, ৯ লাখ, ৭৯ হাজার ৭৩১ টাকার বই। বাংলা একাডেমির দেয়া তথ্যেমতে, ২ হাজার ৬২২টি নতুন বইয়ের মধ্যে গল্প ৩৫১টি, উপন্যাস ৪২২টি, প্রবন্ধ ১৪০টি, কবিতা ৭৫৮, গবেষণা ৫০টি, ছড়া ৫১টি, শিশুতোষ ১১৫টি, জীবনী ৮২টি, রচনাবলি ৪টি, মুক্তিযুদ্ধ ৯৯টি, নাটক ১৪টি, বিজ্ঞান ৫৪টি, ভ্রমণ ৪৮টি, ইতিহাস ৫৭টি, রাজনীতি ৬টি, স্বাস্থ্য ১৭টি, বঙ্গবন্ধুর উপর ৮০টি, রম্য/ধাঁধা ২০টি, ধর্মীয় ১০টি, অনুবাদ ৩০টি, অভিধান ৮টি, সায়েন্স ফিকশন ৪৪টি এবং অন্যান্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ১৬২টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কলম প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী জাকিয়া বলেন, মেলার বেচাকেনা বেশ ভালোই চলছে। আশা করছি বিক্রয়ের ধারা অব্যাহত থাকবে। মিজান পাবলিশার্সের প্রধান নির্বাহী মিজানুর রহমান বলেন, মেলার শেষ সময়ে আসলে বেচাকেনা বেশি হয়। এখন যারা আসছে তাদের প্রায় সবাই বই কিনে নিচ্ছে।
আগামী গ্রন্থমেলায় বই চরিত্র বদলে যাবে: আগামী অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বই চরিত্র বদলে যাবে বলে জানিয়েছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমির শহীদ মুনীর চৌধুরী সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে গ্রন্থমেলার সামগ্রিক অবস্থা তুলে ধরেন মহাপরিচালক।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, ‘মানহীন বই প্রকাশের বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে বাংলা একাডেমি। ২০২১ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আগে বইয়ের মানদণ্ড নির্ধারণে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। মেলার অনেক ঘাটতি পূরণ হয়ে গেছে। এবার ভালো বই আনতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘মেলা শেষে তথ্যকেন্দ্রের তালিকার সঙ্গে প্রত্যেক প্রকাশনীর নতুন বইয়ের তালিকা (ক্যাটালগ) মিলিয়ে দেখা হবে। যেসব বই তথ্যকেন্দ্রে জমা দেয়া হয়নি, সেগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাইরেটেড, ভুলে ভরা ও নি¤œমানের বই ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে অন্যরা এসে তদবির করে বলেও জানান তিনি।
প্রকাশকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এটা বইয়ের এবং বইপ্রেমীদের মেলা। তাদের বুঝতে হবে এটা প্রকাশকদের মেলা নয়। এ মেলায় কখনোই বাণিজ্যিক মনোভাব ছিল না। ভালো বই নিয়ে আসেন, বইয়ের সংখ্যা কম হলেও তাদের সুযোগ দেয়া হবে।’ নান্দনিক মেলা আয়োজনে এবার অন্যতম আকর্ষণ ‘বঙ্গবন্ধু পাঠ’। এখানে বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলো অন্তভুক্ত, চাইলে যে কেউই এখানে বসে পাঠ করতে পারবেন। তবে সংরক্ষিত জায়গাটি পাঠকের বদলে দর্শনার্থীতে ভরে থাকে বেশিরভাগ সময়।
এ প্রসঙ্গে স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর বলেন, ‘এটি একেবারেই নতুন বিষয়। রাতারাতি আসলে কিছু হয় না। মূলত বঙ্গবন্ধুকে পরিপ্রেক্ষিত করে গড়ে তোলা মেলাপ্রাঙ্গণে এটি ছিল খুবই মর্যাদাপূর্ণ বিষয়। তবে দুঃখজনক হলো, এটি এখন সেলফি-জোন হয়ে গেছে।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ ঘিরে শতগ্রন্থের অংশ হিসাবে গতকাল পর্যন্ত ১৮টি নতুন গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে জাতির পিতার লেখা তৃতীয় গ্রন্থ ‘আমার দেখা নয়াচীন’ ঘিরে পাঠকের ব্যাপক উদ্দীপনা দেখা গেছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমির নিজস্ব বিক্রয় এক কোটি নয় লাখ ৭৯ হাজার ৭৩১ টাকা ৫০ পয়সা।
মেলায় শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে তৎপরতার কথা জানিয়ে বাংলা একাডেমির পরিচালক ও মেলা উদযাপন পরিষদের সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের মাঝেই লুকিয়ে আছে আগামী দিনের নিবিষ্ট পাঠক। আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন ও সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় শিশু-কিশোরদের প্রাণোচ্ছল উপস্থিতি ছিল। ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিযোগিতার ফল প্রদান হবে।’ উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির ভারপ্রাপ্ত সচিব ও পরিচালক অপরেশ কুমার ব্যানার্জীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকে।
মূলমে র আয়োজন: বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমে অনুষ্ঠিত হয় মিনার মনসুর ও দিলওয়ার চৌধুরী সম্পাদিত শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আমিনুর রহমান সুলতান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন জাহিদুল হক, জাফর ওয়াজেদ এবং আসলাম সানী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সম্পদ বড়ুয়া।
প্রাবন্ধিক বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর পঁচাত্তর-উত্তর সময়ে প্রগতি ও সুস্থ সংস্কৃতির পক্ষে নিজেদের গড়ে তোলা একদল তরুণ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সাহসী হয়ে ওঠেন কবিতা লেখার ভেতর দিয়ে। ঢাকা ও রাজশাহী ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনেও আলোড়ন তুলেছিল। কয়েকজন তরুণ কবি ও রাজনৈতিক কর্মী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এক্ষেত্রে। শোক থেকে শক্তির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশে প্রতিবাদী যে সাহিত্যধারাটি সৃষ্টি হয় এই ধারার সঙ্গে কবি মিনার মনসুর ও দিলওয়ার চৌধুরীর নাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ওই সময়ে যখন বঙ্গবন্ধুর নামটি উচ্চারণ করা যেত না তখন তারাই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মারকগ্রন্থ উপহার দিয়েছেন যৌথ সম্পাদনায়।