ঢাবি প্রতিনিধি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ১৮টি আবাসিক হলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের (ছাত্রদল) নতুন কমিটি গঠনের পর ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ঘোষিত ৫৯৩ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটিতে অর্ধশতাধিক নেতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এমনকি, বিগত বছরগুলোর ছাত্র নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ও ছাত্রলীগের হয়ে সরব থাকা একাধিক ছাত্রকেও এবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ছাত্রদলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে।
জানা গেছে, শুক্রবার (৮ আগস্ট) সকালে ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় ও সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপনের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে হল কমিটি ঘোষণা করা হয়। তবে এ কমিটিতে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীদের অন্তর্ভুক্তি ঘিরে সংগঠনের ভেতরেই দেখা দিয়েছে অসন্তোষ।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলার পর ‘গণঅভ্যুত্থানে’ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে হলে হলে প্রতিহত করে। পরদিন ১৭ জুলাই হল প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে সব হলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এবার ছাত্রদল সরাসরি হলভিত্তিক কমিটি ঘোষণা করায় শিক্ষার্থীদের মাঝে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
নতুন কমিটিতে ছাত্রলীগ সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে প্রায় অর্ধশত নেতার বিরুদ্ধে। রোকেয়া হলের ছাত্রলীগ কর্মী ছিলেন বর্তমান হল শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মোছা. শ্রাবণী আক্তার। একই হলের সদস্য সচিব আনিকা বিনতে আশরাফের সাথে ছাত্রলীগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অভিযোগ রয়েছে। বুয়েটের বিতার্কিক ছাত্রলীগ নেতা ইমতিয়াজ রাব্বীর সাথে তার ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
কুয়েত মৈত্রী হলের সদস্য সচিব পদায়ন করা হয়েছে জান্নাতুল ফেরদৌস পুতুলকে। যিনি ছাত্রলীগের সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন, থাকতেন মিছিল র্যালির সামনের সারিতে। তিনি ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের কালচারাল টিমের সদস্য ছিলেন। কুয়েত-মৈত্রী হলে এটাচড হওয়া সত্ত্বেও তিনি অবৈধভাবে রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকা বিনতে হোসাইনের সাথে রাজনীতি করতেন।
ঢাবি ছাত্রলীগের সনজিত-সাদ্দাম কমিটিতে উপগণযোগাযোগ সম্পাদক পদে ছিলেন শামসুন্নাহার হলের বর্তমান ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক নিতু রানী সাহা। সুফিয়া কামাল হলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক পদ পাওয়া জাকিয়া সুলতানা আলো সুফিয়া কামাল হলে এটাচড হওয়া সত্ত্বেও থাকতেন রোকেয়া হলে। ছাত্রলীগ নেত্রী সাজিয়া রহমান সিলভীর কাছের ছোটবোন হিসেবে ছাত্রলীগে পরিচিত ছিলেন তিনি।
ঢাবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপনের আপন ছোট ভাই মাহদীজ্জামান জ্যোতি দ্বিতীয় বর্ষে পড়েও ভাইয়ের ক্ষমতায় ভাগিয়েছেন স্যার এ এফ রহমান হলের সদস্য সচিব পদ। তাছাড়া, হল ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসাইন হয়েছেন উক্ত হলের যুগ্ম আহ্বায়ক। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুমেন শাহরিয়ারের আস্থাভাজন হয়েও মুনতাহা মিথ যুগ্ম আহ্বায়ক পদ পান। বাদশাহ বিন ফরহাদ আলভি পান সদস্য পদ।
শহীদুল্লাহ হলের আহ্বায়ক হয়েছেন-মোসাদ্দেক আল হক শান্ত। তার বাবা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছে। পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত। জীববিজ্ঞান অনুষদ ছাত্রলীগের সহসভাপতি পদে থাকা রাকিবুল হাসান সৌরভ পেয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক পদ।ছাত্রলীগের ক্যান্ডিডেটদের সাথে নিয়ে ভিসিকে ফুল দেওয়া মো. আবিদ হাসনাত, ইমরান হোসেন হয়েছেন ফজলুল হক মুসলিম হলের আহ্বায়ক।
ফজলুল হক হল ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী রাকিব হাসান পেয়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক পদ। বেগম খালেদা জিয়াকে কটূক্তি করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া জিয়াউর রহমান হলের শিক্ষার্থী রাজু শেখ পেয়েছেন হলের যুগ্ম আহ্বায়ক পদ। একই হলের ছাত্রলীগের পরিচিত মুখ মাহমুদ হাসান ঢাবি ক্যাম্পাসের কুখ্যাত প্রলয় গ্যাং এর সক্রিয় সদস্য এবং হলের সবচেয়ে উগ্র ছাত্র নির্যাতনকারী বলে পরিচিত। ৫ আগস্টের পরপর সম্মিলিত সিদ্ধান্তে হলের ছাত্র-শিক্ষকরা তাকে বের করে দেয়। এখন সে জিয়া হল ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। ছাত্রলীগের সংসদীয় আসনভিত্তিক কমিটির সদস্য আজিজুল হাকিম ও তৌফিকুল ইসলাম প্রতিক, মাহিন আহমেদ কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক পদ পান।
মাস্টার দ্যা সূর্যসেন হলে ছাত্রলীগের মিছিলের নেতা আতিক মন্ডল ও মাহিদুল ইসলাম ফাহিম হয়েছেন- ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। হাজী মোহাম্মদ মুহসিন হলে ছাত্রলীগের সংসদীয় আসনভিত্তিক কমিটির সদস্য শিবলী রহমান পাভেল, ছাত্রলীগের ক্যান্ডিডেট এবং সৈকতের ক্যাডার মিরাজুল ইসলাম মিরাজের একান্ত আস্থাভাজন মেরাজ শাহরিয়ার অপু, মহিবুল হাসান আকন্দ ও রোমান মিয়া পেয়েছেন হলের যুগ্ম আহ্বায়ক পদ।
জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী শাহরিয়ার লিয়ন হয়েছেন হল শাখার সদস্য সচিব। ছাত্রলীগের পদপ্রার্থী নেতা ফরিদের সহযোগী হাসনাত তারিক জীম ও ফেনী জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সেক্রেটারির সাথে মিটিং করা হলের সক্রিয় কর্মী জিন্নাহ চৌধুরী যুগ্ম আহ্বায়ক পদ পেয়েছেন। মো. সজীব হোসেন গেস্টরুমে জুনিয়রদের নির্যাতনকারীদের অন্যতম। রাত ২-৩ টার সময় জুনিয়রদের ডেকে সিগারেট আনতে পাঠানোসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি পেয়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক পদ।
শেখ মুজিবুর রহমান হলের সক্রিয় ছাত্রলীগ কর্মী আব্দুল্লাহ আল নোমান ও মোস্তফা হোসেন লিখন ও মোমিতুর রহমান পিয়াল পেয়েছেন-যুগ্ম আহ্বায়ক পদ। ইমতিয়াজ আহমেদ হয়েছেন সদস্য। ছাত্রলীগের ঢাবি সভাপতি শয়নের রাজনীতি করা সাদমান বিন শাওন, হলের সভাপতি শান্তর আস্থাভাজন রোমন সরকার হয়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক। অমর একুশে হলের ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী আব্দুল হামিদ পেয়েছেন হলের সদস্য সচিব পদ।
রাকিবুল হাসান রাকিব বিজয় একাত্তর হলের গেস্টরুমের ত্রাস ছিলেন। জুনিয়রদের জুতা নিতে তেড়ে আসায় জুতা রাকিব নামে পরিচিত পান তিনি। পেয়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক পদ। আরকানুল ইসলাম রূপক পেয়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক পদ। ২৪ সালের ৩ আগস্ট ‘এক দফার কবর দে’ ঘোষণা করে হল থেকে বহিষ্কৃত আহমেদ জাবির মাহাম সদস্য পদ পান।জগন্নাথ হলের সক্রিয় ছাত্রলীগ কর্মী ধ্রুব রয় পেয়েছেন সদস্য পদ।
হাজী মুহম্মদ মুহসিন হল শাখা ছাত্রদলে যুগ্ম সদস্য সচিব পদে পদায়ন করা রোমান মিয়া তার নিজস্ব ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে জানান, যে তিনি আগে ছাত্রলীগ করতেন, এখন ছাত্রদল করেন। এবং তিনি অনুরোধ করেন আজকের পর থেকে কেউ যেন তাকে ছাত্রলীগ ট্যাগ না দেয়।
একই হলের ছাত্রদলের সদস্য আহমেদ জাবির মাহাম গত বছরের ৩ আগস্ট এক দফা ঘোষণার দিনে ফেসবুকে জনে জনে খবর দে, এক দফার কবর দে কমেন্ট করেছিলেন। এমনকি, তার ছাত্রলীগ সম্পৃক্ততার কারণে তার ব্যাচের শিক্ষার্থীরা তাকে ডিপার্টমেন্টে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। এছাড়াও, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রাজু শেখের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়াকে অপমান করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি গত বছরের ৩ আগস্ট ফেসবুকে শেখ হাসিনার বিকল্প হিসেবে খালেদা জিয়াকে চাওয়া নিয়ে লিখেছিলেন মানুষ এত বলদ না!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাকিব বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন ক্যাম্পাসে আমরা নির্যাতন নিপীড়নহীন গণরুম গেস্টরুমহীন একটা ক্যাম্পাসের স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই স্বপ্নে শেষ পেরেকটা মেরেছে ছাত্রদল। জুলাইয়ে আমাদের সকল স্টেকের দাবির মুখে হল প্রশাসন হলে হলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ঐতিহাসিক ৯ দফার মধ্যে একটা দফা ছিল ক্যাম্পাসে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে। কিন্তু সেই শর্ত ভঙ্গ করে প্রথমে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির সূচনা করে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ। তারপর শিবির ও ছাত্রদলও এর পালে হাওয়া লাগায়৷ কিন্তু এবারই প্রথম কোনো ছাত্র সংগঠন সরাসরি আবাসিক হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতি ফেরায়৷ এটা আমাদের গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট বিরোধী, আমাদের শিক্ষার্থীদের সাথে স্রেফ প্রতারণার শামিল। অন্যদিকে এ কমিটির মাধ্যমে অসংখ্য ছাত্রলীগকে আশ্রয় দিয়েছে ছাত্রদল।
জানা গেছে, শিপনের ছোট ভাই ২০২২-২৩ সেশনের মো. মাহদীজ্জামান জ্যোতিকে ওই হলের সদস্য সচিব বানানো হয়েছে। ২০২২ সাল থেকে জাতীয়তাবাদী আদর্শ বুকে লালন করে রাষ্ট্রযন্ত্রের বুট-বুলেটের সামনে বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। আন্দোলন পরবর্তী বিশাল বিশাল সুযোগ সুবিধার প্রস্তাবনা পাওয়া স্বত্বেও মা, মাটি, মানুষ ঘিরে নিজের আদর্শ বিক্রি করিনি। অথচ আজকে আমার ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং বিশ্বস্ততার প্রতিদান দিলেন ঢাবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন নেপোটিজম করে তার নিজের আপন ছোট ভাইকে আমার জায়গায় বসিয়ে।
ঢাবি ছাত্রদলের ১৮টি হলে সর্বমোট পদায়ন করা হয় ৫৯৩ জন শিক্ষার্থীকে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক নেতার বিরুদ্ধেই রয়েছে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাখা ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মতন একটি গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠনের কমিটি গঠন প্রক্রিয়াতে একই পদের জন্য একাধিক যোগ্য কর্মী থাকার কারণে সকলকে তার কাঙ্ক্ষিত পদে দায়িত্ব দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। আমাদের হল কমিটিসমূহ গঠনের ক্ষেত্রে এরকম অনেক কঠিন ও কষ্টকর সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়েছে। আমরা আশা করি সকলেই দল ও আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকবেন।’
তিনি বলেন, ‘এছাড়া নবপ্রকাশিত কমিটিতে পদায়িত কেউ যদি অনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত থাকেন কিংবা সদস্য ফরম ও কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় তথ্য গোপন করে থাকেন তবে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্তপূর্বক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে এসব অভিযোগ সামনে আসলে বিষয়টি তদন্ত করার জন্য ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে শাখা ছাত্রদল। তারা হলেন-শাখা ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি মাসুম বিল্লাহ, সিনিয়র যুগ্মসাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন শাওন ও সাংগঠনিক রাজনীতি নূর আলম ভূঁইয়া ইমন। আগামী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে তাদেরকে লিখিত প্রতিবেদন পেশ করতে বলা হয়েছে।