জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘ উপনিবেশবিরোধী ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের একটি স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা। তাঁর মতে, ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান—এই প্রতিটি ঐতিহাসিক পর্যায় একই ধারার অংশ, যেখানে বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের মর্যাদা, পরিচয় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। মাহফুজ আলম জানান, ২০২৪ সালের ঘটনাবলিকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দাঁড় করানোর যে প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে, তা ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাঁর ভাষায়, বাংলাদেশের ইতিহাসকে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনার সমষ্টি হিসেবে দেখলে প্রকৃত প্রেক্ষাপট অনুধাবন করা সম্ভব হয় না।
তিনি বলেন, একটি মতবাদ রয়েছে যেখানে ১৯৭১ সালকে ১৯৪৭ সালের বিপরীত বা ‘অ্যান্টিথিসিস’ হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি ঐতিহাসিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। তাঁর ব্যাখ্যায়, ১৯৪৭ সালের পর থেকে বাংলাদেশের মানুষ ধারাবাহিকভাবে ভাষা, সংস্কৃতি, গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে যুক্ত থেকেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যেও এই ভূখণ্ডের মানুষের মূল লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
মাহফুজ আলমের মতে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ—এই ঘটনাগুলো আলাদা কোনো বিচ্ছিন্ন অধ্যায় নয়। বরং প্রতিটি পর্বে নতুন প্রজন্ম আগের প্রজন্মের সংগ্রামকে সামনে রেখে নিজেদের ভূমিকা পালন করেছে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত অধিকার প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়।
তিনি আরও বলেন, ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানও এই ধারাবাহিকতার বাইরে নয়। সামরিক শাসনবিরোধী ওই আন্দোলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা হয়েছিল, সেটিও বাংলাদেশের মানুষের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার দীর্ঘ ইতিহাসের অংশ। একইভাবে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবকে আগের আন্দোলনগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
মাহফুজ আলমের বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ইতিহাসে যতবার অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক আধিপত্য ও উপনিবেশিক প্রবণতা দেখা দিয়েছে, ততবারই জনগণ তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তিনি বলেন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়কালকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময় হিসেবে দেখা যেতে পারে। ওই সময়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক দমননীতি এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার হয়।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশের সংগ্রামের ধরন ও লক্ষ্য কিছুটা ভিন্ন রূপ নেয়। তাঁর মতে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এই লড়াই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও আঞ্চলিক আধিপত্যের প্রভাব মোকাবিলার দিকেও বিস্তৃত হয়েছে। তবে মূল সুর একই থেকেছে—জাতীয় মর্যাদা, সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের অধিকার রক্ষা।
বিজয় দিবস উপলক্ষে মাহফুজ আলম বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তিনি বলেন, এই ভূখণ্ডের ইতিহাসে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের আত্মত্যাগ কোনো বিভাজনের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা যায় না। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, সব শহীদের রক্ত একইভাবে এই দেশের মাটিতে মিশে আছে এবং সবাই একই লক্ষ্য সামনে রেখে লড়াই করেছেন।
মাহফুজ আলমের এই বক্তব্য সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বিতর্কের প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যাখ্যা নিয়ে চলমান আলোচনায় তাঁর বক্তব্য একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে, যা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে আরও আলোচনার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।