জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল–বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকায় পৌঁছেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর। একই দিন দুপুরে তিনি জাতীয় সংসদ ভবনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার হাতে ভারতের রাষ্ট্রীয় শোকবার্তা আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেন। ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ ফ্লাইটে বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে তিনি ঢাকায় অবতরণ করেন। সফরসূচি অনুযায়ী, বিকেলেই তার ঢাকা ত্যাগ করার কথা রয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের এ সফর মূলত শোক ও কূটনৈতিক সৌজন্যের বার্তা বহন করছে। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, যিনি ১৯৯১, ১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারি) এবং ২০০১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তার মৃত্যুর পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। তার রাজনৈতিক জীবন গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের বিকাশ, নির্বাচন–কেন্দ্রিক রাজনীতির প্রসার এবং আঞ্চলিক কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে গেছে।
ঢাকায় পৌঁছানোর পর জয়শঙ্কর প্রথমে সংক্ষিপ্ত বিশ্রাম নেন। এরপর বেলা সাড়ে ১২টার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তিনি। বৈঠকটি আনুষ্ঠানিক শোকবার্তা হস্তান্তরকে কেন্দ্র করে হলেও এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ–ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, আঞ্চলিক সহযোগিতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখার বার্তাও ফুটে ওঠে। বৈঠক–পরবর্তী বিবরণে জানা যায়, শোকবার্তায় ভারত খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শ্রদ্ধা ও সমবেদনা জানায় এবং স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশে তার অবদানের স্বীকৃতি তুলে ধরে।
ভারতের শোকবার্তা হস্তান্তর অনুষ্ঠানটি সংক্ষিপ্ত হলেও তা ছিল রাষ্ট্রীয় প্রোটোকল মেনে সম্পন্ন। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন দক্ষিণ এশিয়ার ভূ–রাজনীতিতে একটি প্রভাবশালী অধ্যায়, যেখানে তিনি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ সফর ভারতের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের যোগাযোগের ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বহিঃপ্রকাশ।
ঢাকা সফরের সময় জয়শঙ্করের নিরাপত্তায় ছিল বাংলাদেশ সরকার ও ভারতীয় বিমানবাহিনীর সমন্বিত প্রোটোকল ব্যবস্থা। বিমানবন্দর থেকে সংসদ ভবন পর্যন্ত যাতায়াতে কূটনৈতিক কনভয় ব্যবহার করা হয়। সফরটি যেহেতু শোক–সংশ্লিষ্ট, তাই এতে কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, অর্থনৈতিক সমঝোতা বা আনুষ্ঠানিক নীতি–সংক্রান্ত আলোচনা রাখা হয়নি। তবে বৈঠকে আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে সংক্ষিপ্ত মতবিনিময় হয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সরাসরি উপস্থিতিতে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে শোকবার্তা হস্তান্তর দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষত, ২০২৪–পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে এ সফর কূটনৈতিক সৌহার্দ্যের পাশাপাশি আঞ্চলিক বাস্তবতাকেও প্রতিফলিত করছে।
তারেক রহমান, যিনি ২০১৮ সালের পর থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, বৈঠকে ভারতের শোকবার্তা গ্রহণ করেন এবং ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। বিএনপির চেয়ারপার্সনের অনুপস্থিতিতে দলের নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক কাঠামো বর্তমানে তারেক রহমানের তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হচ্ছে। ফলে তার কাছে এ শোকবার্তা হস্তান্তরকে আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক স্বীকৃতি ও সৌজন্য–সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের ঢাকা ত্যাগের সময়সূচি অনুযায়ী, বিকেল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে তিনি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকা ছাড়বেন। সফরটি সংক্ষিপ্ত হলেও এর মাধ্যমে দুই দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে পারস্পরিক সম্মান ও সৌজন্যের বার্তা স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে। কূটনৈতিক মহল মনে করে, শোক–সংশ্লিষ্ট সফরগুলো ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ভিত্তি নির্ধারণ না করলেও তা পারস্পরিক আস্থা ও যোগাযোগের নীরব সেতুবন্ধন তৈরি করে, যা আঞ্চলিক রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে বহুমাত্রিক, যেখানে সরকার–টু–সরকার সম্পর্কের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব পর্যায়ের যোগাযোগও আঞ্চলিক সমীকরণে ভূমিকা রাখে। এ সফর সেই যোগাযোগের প্রাতিষ্ঠানিক ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবেই মূল্যায়িত হচ্ছে।