আইন আদালত ডেস্ক
সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে দায়ের করা আপিলের শুনানি শেষ করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বুধবার (৫ নভেম্বর) সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে মামলার অষ্টম দিনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
শুনানিতে ব্যারিস্টার কাজল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ এবং এই ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অন্ধকার নেমে আসে। তিনি সংবিধানের সেই ধারা পুনর্বহালের অনুরোধ জানান। বিএনপির পক্ষে শুনানি শেষ হলে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি শুরু করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক।
এর আগে টানা কয়েক দফায় গত ২১ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত আপিলের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে আদালত ১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা, ২০১১ সালের রায়ের প্রভাব এবং পরবর্তীতে পাস হওয়া পঞ্চদশ সংশোধনীর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় শোনে উভয় পক্ষের যুক্তি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে, যা ১৯৯৬ সালের মার্চে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে আইনজীবী এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।
পরবর্তীতে ২০০৫ সালে রিট আবেদনকারীরা আপিল করেন। আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ও বাতিল ঘোষণা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পাস হয় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী, যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হয়।
তবে গত বছর এ রায় পুনর্বিবেচনার জন্য একাধিক আবেদন জমা পড়ে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর নাগরিক সমাজের সংগঠন ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’ (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন বিশিষ্ট নাগরিক পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান।
অন্যদিকে, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর একই বিষয়ে পৃথক পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। একই বছরের ২৩ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারও পৃথক আবেদন জমা দেন। পরবর্তীতে নওগাঁর রানীনগরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের রায় পুনর্বিবেচনার অনুরোধে আবেদন করেন।
এর আগে ২৭ আগস্ট হাইকোর্টের রায় পুনর্বিবেচনা শুনানি শেষে আপিল বিভাগের অনুমতি দেওয়া হয়। এর পর থেকেই এ বিষয়ে একাধিক পক্ষ আদালতে যুক্ত হয়ে আপিল দাখিল করে।
বুধবার বিএনপির শুনানি শেষে আদালত রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি শোনার কাজ শুরু করেছে। আদালতের নির্দেশে আগামী কয়েক কার্যদিবস রাষ্ট্রপক্ষের শুনানি চলবে বলে জানা গেছে। এরপর পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ রায়ের জন্য বিষয়টি অপেক্ষমাণ রাখবে বলে আইন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
আইনজীবী মহলের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল সংক্রান্ত এ রায়ের ওপর নির্ভর করছে দেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনকালীন প্রশাসনের ধরন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার গতিপথ। আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।