আইন আদালত ডেস্ক
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার ঘটনায় সাতজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তদন্তে জানা গেছে, উদ্যানে গাঁজা বিক্রি নিষেধ করায় তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আখতার মোর্শেদ বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চার্জশিট জমা দেন। তিনি জানান, মামলায় সাতজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে অভিযুক্তরা হলেন—মেহেদী হাসান, মো. রাব্বি ওরফে কবুতর রাব্বি, মো. রিপন ওরফে আকাশ, নাহিদ হাসান পাপেল, মো. হৃদয় ইসলাম, মো. হারুন অর রশিদ সোহাগ ওরফে লম্বু সোহাগ এবং মো. রবিন। তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, এরা সবাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
অন্যদিকে, অব্যাহতির সুপারিশ পাওয়া চারজন হলেন—তামিম হাওলাদার, সম্রাট মল্লিক, পলাশ সরদার ও সুজন সরকার।
গত ১৩ মে রাত ১১টার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে ছুরিকাঘাতে আহত হন শাহরিয়ার আলম সাম্য (২৫)। পরবর্তীতে রাত ১২টার দিকে তার বন্ধুরা তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নিহত সাম্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং এফ রহমান হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন। পরদিন (১৪ মে) সকালে নিহতের বড় ভাই শরীফুল ইসলাম শাহবাগ থানায় ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন।
অভিযোগপত্র অনুযায়ী, আসামি মেহেদী হাসান ও তার সহযোগীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়মিত গাঁজা বিক্রি করতেন। তারা মন্দির গেট এলাকার ভেতরে খুচরা বিক্রি শেষে মেহেদীর কাছে টাকা জমা দিত। ঘটনার পূর্বে রিপন ও রাব্বি মেহেদীকে জানায়, কিছু মাস্তান তাদের গাঁজা বিক্রির টাকা ছিনিয়ে নেয়ায় তারা নিয়মিত টাকা দিতে পারছে না। এ নিয়ে মেহেদী ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের দলকে প্রতিহতের নির্দেশ দেয় এবং তাদের মধ্যে কয়েকজনকে সুইচ গিয়ার চাকু ও ইলেকট্রিক ট্রেজারগান সরবরাহ করে।
এ সময় সাম্য ও তার বন্ধুরা উদ্যানে মাদক বিক্রি না করতে নিষেধ করলে উভয়পক্ষের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। ঘটনার রাতে কবুতর রাব্বি ট্রেজারগান হাতে গাঁজা বিক্রি করছিল। সাম্য তাকে থামতে বললে রাব্বি দৌড়ে পালিয়ে যায়। সাম্য মোটরসাইকেলে ধাওয়া করে রাব্বিকে ধরে ফেলে এবং ট্রেজারগানটি নিতে চাইলে উভয়ের মধ্যে হাতাহাতি হয়। রাব্বির চিৎকারে অন্য আসামিরা—মেহেদী, রিপন, পাপেল, হৃদয়, সোহাগ ও রবিন ঘটনাস্থলে এসে সাম্য ও তার বন্ধুদের ওপর হামলা চালায়।
ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে মেহেদী হাসান সুইচ গিয়ার চাকু দিয়ে সাম্যর ডান পায়ে আঘাত করে। এতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
তদন্তে জানা যায়, তামিম হাওলাদার, সম্রাট মল্লিক ও পলাশ সরদার ঘটনাস্থলে পথচারী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তারা উদ্যানে ঘুরতে এসে সাম্যকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন এবং সংঘর্ষে আহত হন। তদন্তে তাদের কারও সঙ্গে মূল আসামিদের পূর্বপরিচয় বা হত্যার ঘটনায় সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। একইভাবে সুজন সরকারও ঘটনাস্থলে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না। তিনি ঘটনার পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাম্যর মৃত্যুর বিষয়ে পোস্ট করেন, যা ভুলভাবে সন্দেহের জন্ম দেয়।
তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, হত্যাকাণ্ডটি উদ্যানে মাদক বিক্রির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ থেকে ঘটেছে। মূল আসামিরা পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী এবং ঘটনাটি পূর্ব পরিকল্পিত না হলেও তা সংঘটিত হয় মুহূর্তের উত্তেজনা থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা সাম্য হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং পুলিশ তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। চার্জশিট আদালতে দাখিলের পর মামলাটি বিচারিক প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হবে বলে জানা গেছে।
তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদন অনুযায়ী, অব্যাহতির সুপারিশ পাওয়া চার আসামির বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকলেও বাকি সাতজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য, ফরেনসিক ও প্রত্যক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। আদালত এখন চার্জশিটটি গ্রহণ করে পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করবেন।