আইন আদালত ডেস্ক
১৭তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন (বিজেএস) পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়ে কমিশনের সুপারিশ পাওয়া ১৩ প্রার্থী আইন মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত নিয়োগ-গেজেটে স্থান পাননি। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়া এ প্রার্থীদের পরিবার, শিক্ষক এবং সহপাঠীদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে ১০০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০২৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। কমিশন ২৩ ফেব্রুয়ারি ১০২ জনকে সুপারিশ প্রদান করে। তবে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২৭ নভেম্বর প্রকাশিত নিয়োগ-গেজেটে দেখা যায়, মাত্র ৮৮ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সুপারিশপ্রাপ্ত বাকি ১৩ জনের নাম কোনো কারণ উল্লেখ ছাড়াই বাদ রাখা হয়েছে।
গেজেটভুক্ত না হওয়া ১৩ প্রার্থীর মধ্যে রয়েছেন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তানসেনা হোসেন মনীষা, অনিক আহমেদ, মাহমুদুল ইসলাম মুন্না ও গগন পাল; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিশাত মনি, নাহিম হাসান, মো. রেজাউল ইসলাম ও সাজ্জাদুল হক; গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদিকুর রহমান; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইমন সৈয়দ; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মামুন হোসেন; বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুব্রত পোদ্দার এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হুমায়রা মেহনাজ।
প্রার্থীরা জানান, তাদের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক বিতর্ক বা ফৌজদারি মামলা নেই। তারা সম্পূর্ণ মেধা, যোগ্যতা ও প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বিচারক হওয়ার সুপারিশ পেয়েছেন। এদের অভিযোগ, ব্যক্তিগত পরিচয় নয়, বরং আত্মীয়স্বজনের রাজনৈতিক পরিচয়কে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া গোয়েন্দা রিপোর্টের কারণে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। তারা এটি সংবিধান ও সুশাসনের পরিপন্থি বলেও উল্লেখ করেন।
তানসেনা হোসেন মনীষা বলেন, “আমি ১৭তম বিজেএস পরীক্ষায় ২৫তম মেধাক্রমে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। মেডিকেল পরীক্ষা ও ভেরিফিকেশনসহ সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি। কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা নেই, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাও নেই। তারপরও গেজেটে নাম নেই। এতে আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়েছি।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইমন সৈয়দ জানান, “আমার নামে কোনো মামলা নেই এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত নই। গেজেটে নাম না দেখে পরিবার ভীষণ হতাশ। আমার ৮৬ বছর বয়সী অসুস্থ মা কষ্টে আছেন। এটি ন্যায্য নয়।”
সাদিকুর রহমান, নাহিম হাসান ও মাহমুদুল হোসেনও জানিয়েছেন, তারা সম্পূর্ণ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সুপারিশপ্রাপ্ত, অথচ গেজেটে বাদ পড়ার ফলে চাকরির আগমনের ব্যাপারে প্রতিসমতা বিঘ্নিত হয়েছে। তারা সবাই আইন মন্ত্রণালয় থেকে তাদের নাম অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছেন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সরদার কাইসার আহমেদ বলেছেন, “সুব্রত পোদ্দারকে কোনো ধরনের অবিচার মেনে নেওয়া যাবে না। তার সংগ্রাম, অধ্যবসায়, সততা ও নৈতিকতার কারণে বিচারপ্রক্রিয়ায় তার অবদান স্বীকৃত হওয়া উচিত।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবু নাসের মোহাম্মদ ওয়াহিদ বলেন, “এ ধরনের প্র্যাকটিস পূর্বেও দেখা গেছে। তখন গণআন্দোলন হয়েছিল। মেধাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে বলেও বলা হয়েছিল। বর্তমান সিদ্ধান্ত সেই গণআকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মোহা. ফরিদ উদ্দীন খান মন্তব্য করেছেন, “আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত থাকলে চাকরি হবে না—এটি অসাংবিধানিক। পূর্ববর্তী সরকারের আমলেও এমন ঘটনা ঘটলেও প্রতিবাদ করা হয়েছিল। বাবার পরিচয়ে ছেলের চাকরি পাওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। এটি পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত।”
এই পরিস্থিতি প্রার্থীদের নৈতিক ও পেশাগত অধিকার, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং বিচার ব্যবস্থায় মেধাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়ার গুরুত্ব নিয়ে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। আইন মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি।