আইন আদালত ডেস্ক
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের সব ধরনের কার্যক্রম স্থগিতের আবেদন জানিয়ে করা রিটকে ‘উত্থাপিত হয়নি’ মন্তব্য করে খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। সোমবার বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজী ও বিচারপতি রিয়াজউদ্দিন আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। রিটকারী আইনজীবী মো. ইয়ারুল ইসলাম আদালতে আবেদনটি আর না-চালানোর অনুরোধ করলে আদালত আবেদনটি নট প্রেসড হিসেবে খারিজ করেন।
রিটকারীর পক্ষে জানানো হয়, নির্বাচন সামনে থাকার প্রেক্ষাপটে আদালত আবেদনটির উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে বৃহত্তর জনস্বার্থের বিষয়টি বিবেচনা করে তিনি রিটটি আর উপস্থাপন না করার সিদ্ধান্ত নেন। মো. ইয়ারুল ইসলাম নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ কংগ্রেস’-এর মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দলের পক্ষে তিনি ৩ ডিসেম্বর রিট আবেদনটি করেছিলেন।
রিট আবেদনে বর্তমান নির্বাচনব্যবস্থায় জেলা প্রশাসককে (ডিসি) রিটার্নিং অফিসার এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। আবেদনে যুক্তি তুলে ধরা হয়, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন দেশের সব জাতীয় নির্বাচন আয়োজন ও পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। এ ক্ষেত্রে কমিশনকে সহায়তা করা নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব হলেও কমিশনের নিজস্ব জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ডিসি ও ইউএনওদের ওপর অর্পণ করা কমিশনকে নির্বাহী বিভাগের ওপর নির্ভরশীল করে। এর ফলে নির্বাচন পরিচালনাবিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় কমিশনের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হতে পারে—এমন আশঙ্কা রিটে উল্লেখ করা হয়।
রিটে বলা হয়, ডিসি ও ইউএনওরা নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তা হওয়ায় তারা সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। ফলে রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ব্যালট পেপার ছাপানো, ব্যালট বাক্স প্রস্তুত ও সরবরাহ করার মতো কারিগরি কাজ ব্যতীত নির্বাচন পরিচালনার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কমিশনের কর্তৃত্ব সীমিত হয়ে পড়ে। রিটে যুক্তি দেওয়া হয় যে নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তারা নির্বাচন পরিচালনার বাস্তব অভিজ্ঞতা সাধারণত অর্জন করেন না, অন্যদিকে কমিশনের অধীনে থাকা পেশাদার নির্বাচন কর্মকর্তারাই এই বিষয়ে অভিজ্ঞ। তাই নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা এবং পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের ধাপে ধাপে পদোন্নতির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
রিট আবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বিচার বিভাগের মতো স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল কাঠামো থাকা জরুরি। যেমন বিচার বিভাগে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন এবং নিজস্ব সচিবালয় গঠনের মাধ্যমে বিচারিক স্বাধীনতা সুদৃঢ় হয়েছে, তেমনি নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রেও একটি ‘ইলেকটোরাল সার্ভিস কমিশন’ গঠনের দাবি রিটে জানানো হয়। রিটকারীর দাবি ছিল, কমিশন সচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাহী বিভাগ থেকে কর্মকর্তাদের প্রেষণ বা নিয়োগ দেওয়া কমিশনের সাংবিধানিক স্বাধীনতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। কমিশনের নিজস্ব জনবল থেকে এসব পদে নিয়োগ নিশ্চিত করতে স্বতন্ত্র কাঠামো প্রণয়ন জরুরি—এমন মত রিটে তুলে ধরা হয়।
রিটে প্রশ্ন তোলা হয়, কেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের পরিবর্তে ডিসি ও ইউএনওদের রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। এ বিষয়ে রুল জারি করার অনুরোধ জানানো হয়। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে নির্বাহী বিভাগ থেকে প্রেষণে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে রুল জারির আবেদন করা হয়। রিটে আরও বলা হয়, যদি আদালত রুল জারি করেন, তবে রুল নিষ্পত্তির আগে পর্যন্ত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের সব কার্যক্রম স্থগিত রাখতে নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন।
প্রাথমিক শুনানিকালে আদালত আবেদনটির সময়োপযোগিতা ও নির্বাচন-সংক্রান্ত প্রক্রিয়ার অগ্রগতি বিবেচনা করে রিটটি উত্থাপিত হয়নি বলে মন্তব্য করেন। আদালতের পর্যবেক্ষণের পর রিটকারী আবেদনটি আর না-চালানোর অনুরোধ করলে হাইকোর্ট নট প্রেসড হিসেবে রিট খারিজ করে দেন।
আদেশের ফলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের যাবতীয় কার্যক্রম পূর্বঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী চলমান থাকবে। নির্বাচনের প্রশাসনিক ও মাঠপর্যায়ের দায়িত্ব বণ্টনও বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী ডিসি ও ইউএনওদের ওপরই বহাল থাকছে। নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, কেন্দ্র স্থাপন, ব্যালট পেপার প্রস্তুত ও নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট জনবল নিযুক্তির কাজ, যা নির্বাচন কমিশন পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে নিচ্ছে।
আইনজীবী রিটটি প্রত্যাহার করায় নির্বাচন কমিশনের কাঠামো ও নিয়োগব্যবস্থা বিষয়ে রিটে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর বিচারিক পর্যালোচনা আপাতত সমাপ্ত হলো। তবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নীতিগত বা সাংবিধানিক বিতর্ক ভবিষ্যতে পৃথক আইনি উদ্যোগ বা নীতিমালার মাধ্যমে পুনরায় আলোচনায় আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা।