বিনোদন ডেস্ক
ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্র নির্মাণ কার্যক্রমে স্থবির অবস্থার মুখোমুখি। শুটিং ও ডাবিং ফ্লোরে তারকাদের উপস্থিতি কমে গেছে, লাইটের ঝলকানি নেই এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের সরঞ্জামাদি প্রাচীন ও অপ্রতুল। এ পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে ২০২২ সালে শুরু হওয়া বিএফডিসি কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পও নির্ধারিত সময় পার হয়ে ২০২৪ সালের জুনে সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকা সত্ত্বেও অর্ধেকের বেশি কাজ সম্পন্ন হয়নি।
বিএফডিসি ১৯৫৭ সালে যাত্রা শুরু করে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে অবদান রেখেছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি ব্যবসায়িক ও প্রশাসনিক কেন্দ্রের রূপ নিয়েছে। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, সংস্থার দাপ্তরিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম সিনেমার উন্নয়নের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। ২০১৮ সালে একনেকের অনুমোদনে ১২ তলা বিশিষ্ট ‘বিএফডিসি কমপ্লেক্স’ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, যার ব্যয় ধরা হয় ৩২৩ কোটি টাকা। প্রকল্পে মূলত ৩, ৪ ও ৫ নম্বর শুটিং ফ্লোর এবং এডিটিং ভবন ভেঙে নতুন বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২২ সালে। বর্তমানে মাত্র ৪০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্প কর্মকর্তা জানাচ্ছেন, নানা কারণে সময়মতো নির্মাণ শেষ করা যায়নি। সংশোধিত সময়সূচি অনুযায়ী ২০২৬ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আশা করা হচ্ছে। আর ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬৫ কোটি টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
এফডিসির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুমা রহমান তানি জানান, গত ১৬ বছরে সংস্থার আধুনিকায়নে কোনো বিনিয়োগ হয়নি। আধুনিক প্রযুক্তির অপ্রতুলতা, জরাজীর্ণ স্টুডিও এবং সরঞ্জামের অভাবে প্রতিষ্ঠানটি দিন দিন তার পুরনো গৌরব হারিয়েছে। বর্তমানে সংস্থার হাতে প্রাগৈতিহাসিক মানের আটটি ক্যামেরা রয়েছে, যা যথাযথভাবে কার্যকর নয়। ২০১৭ সালে আনা কিছু ক্যামেরা বর্তমানে সময়োপযোগী নয়। চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজকরা বাইরে থেকে উন্নত প্রযুক্তির ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতি ভাড়া নিয়ে কাজ করছেন।
শুটিং ফ্লোর, ডাবিং শাখা এবং এডিটিং শাখার সরঞ্জামাদি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারহীন। ৫.১ বা ৭.১ সারাউন্ডিং সাউন্ড সিস্টেম নেই। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের জন্য ব্যবহৃত সফটওয়্যার ও ডাবিং মেশিন দীর্ঘদিন ধরে অচল। এডিটিং শাখার মেশিন ও ডিসিপি (ডিজিটাল সিনেমা প্যাকেজ) যন্ত্রপাতিও ব্যবহারযোগ্য নয়। ২০০৭ সালের ডিজিটাল সাউন্ড ইকুইপমেন্ট এখন অকেজো অবস্থায় রয়েছে।
সংস্থার আয়-ব্যয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিচালন ও সেবা খাত থেকে আয় ছিল ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা, যেখানে খরচ হয়েছে ২৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০২৪-২৫ সালে আয় দাঁড়ায় ৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, ব্যয় হয়েছে ২৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এক দশকে সরকারি অনুদান ও ঋণ মিলিয়ে সংস্থার হাতে এসেছে ৮০ কোটি টাকা। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধারাবাহিক লোকসানের পরিমাণ ১৪২ কোটি টাকা। এই অবস্থার কারণে সংস্থা সীমাহীন অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
ফ্লোরের অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে; ছাদ থেকে পানি পড়া, এসি নষ্ট এবং শুটিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় স্পটের অভাব রয়েছে। আগে নয়টি শুটিং ফ্লোর থাকলেও বর্তমানে ৫টি ফ্লোর কার্যকর রয়েছে, যার মধ্যে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
এফডিসির প্রশাসন জানিয়েছেন, আয় বৃদ্ধি এবং কাজের পরিবেশ উন্নয়নের জন্য শুটিং ও ডাবিং ফ্লোরের ভাড়া কমানো হয়েছে। পরিচালনার লক্ষ্য হলো সংস্থাটিকে পুনরায় লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে আসা। আধুনিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি যুক্ত হলে সংস্থা আবারও সক্রিয় এবং লাভজনক হয়ে উঠতে পারবে।
চলচ্চিত্রকাররা এই অবস্থার কারণে সংস্থার কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সদ্য বিদায়ী তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বক্তব্য, সংস্থাকে গবেষণাগার হিসেবে রূপান্তরিত করা উচিত, তা চলচ্চিত্র দুনিয়ার মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায়, সংস্থার পুনর্গঠন ও আধুনিকায়ন ছাড়া এফডিসির চলচ্চিত্র নির্মাণ কেন্দ্র হিসেবে পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।

