নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকা-৮ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদি হত্যাকাণ্ডে ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে পরিকল্পিত একটি ‘কিলিং মিশন’ বাস্তবায়নের তথ্য পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থাগুলো। তদন্তে উঠে এসেছে, হত্যাকাণ্ডের মূল সন্দেহভাজন শুটার ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ ঘটনার আগে বিদেশে অবস্থানকালে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন এবং সেখানেই হত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা হয়। পরে দেশে ফিরে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হাদিকে হত্যা করা হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল গত ২১ জুলাই সিঙ্গাপুর যান এবং ২৬ জুলাই দেশে ফেরেন। এই পাঁচ দিনের সফরেই হত্যাকাণ্ডের ছক চূড়ান্ত করা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। সিঙ্গাপুরে পৌঁছানোর পর তিনি সড়কপথে মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় যান, যেখানে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেসব বৈঠকে পলাতক কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা অংশ নেন বলে তদন্তে ইঙ্গিত মিলেছে। সফরের সময় ফয়সাল নিজেকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচয় দেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ফয়সালের ভ্রমণসংক্রান্ত নথি যাচাই করে সিঙ্গাপুর সফরের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে বিস্তারিত তথ্য আপাতত প্রকাশ করা যাচ্ছে না।
হত্যাকাণ্ডের আগে ফয়সাল তার স্ত্রী সাহেদা পারভীন ও প্রেমিকা মারিয়া আক্তারকে কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে। সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পর স্ত্রীকে তিনি জানান, সামনে এমন সময় আসতে পারে যখন দেশে থাকা সম্ভব নাও হতে পারে। এ সময় একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৩০ লাখ টাকা থাকার কথা উল্লেখ করে পরিবারকে আর্থিকভাবে নিরাপদ থাকার আশ্বাস দেন। তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, এসব তথ্য স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় উঠে এসেছে।
প্রেমিকা মারিয়া আক্তারের জবানবন্দিতেও প্রায় একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তে জানা যায়, ১২ ডিসেম্বর হত্যাকাণ্ডের আগের রাতে ফয়সাল, মোটরসাইকেলচালক আলমগীর শেখ ও মারিয়া সাভারের একটি কটেজে সময় কাটান। ওই রাতে ফয়সাল মারিয়াকে বলেন, পরদিন এমন একটি ঘটনা ঘটবে যা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করবে। তবে স্ত্রী ও প্রেমিকা দুজনই দাবি করেছেন, ঘটনার প্রকৃতি বা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তারা আগে থেকে কিছুই বুঝতে পারেননি।
হত্যার পর ফয়সাল ও আলমগীরকে ভারত পালাতে সহায়তাকারী নেটওয়ার্কও শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ঘটনায় যুবলীগের এক নেতার ভগ্নিপতি আমিনুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ডিবি ও র্যাবের অভিযানে মোট ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
তদন্তে আরও জানা গেছে, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মিরপুরের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে বাপ্পী ফয়সাল ও আলমগীরের সীমান্ত পারাপারের পুরো ব্যবস্থাপনা করেন। ঘটনার রাতেই তারা ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে পালিয়ে যান। সীমান্ত পারাপারের জন্য আগেভাগেই প্রস্তুতি নেওয়া ছিল এবং স্থানীয় কয়েকজন দালালের সহায়তায় এ কাজ সম্পন্ন হয়।
তদন্ত সূত্র জানায়, হালুয়াঘাট এলাকায় অবৈধ পারাপারে জড়িত দালালদের একজনের মাধ্যমে সীমান্ত পার হওয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের পরপরই সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ফোনালাপ ও অর্থ লেনদেনের তথ্যও তদন্তে উঠে এসেছে, যা পালানোর পরিকল্পনাকে সুসংগঠিতভাবে বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দেয়।
এদিকে, হাদি হত্যার বিচার দাবিতে ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীরা রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন। জুমার নামাজের পর সেখানে অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়, ফলে ওই এলাকায় সাময়িকভাবে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সংগঠনের নেতারা জানান, বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
তদন্তকারী সংস্থাগুলো বলছে, হত্যাকাণ্ডের পেছনের মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতাদের শনাক্ত করতে অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। দেশ-বিদেশে থাকা সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা নিরূপণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে পলাতকদের আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।