তারিকুল ইসসাংগঠনিক জেলাগুলোতে আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। গত ২ বছরে ৩৩ জেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিগুলোর প্রতি নির্দেশনা রয়েছে ৩ মাসের মধ্যে অধীন থানা-উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি গঠন করতে হবে।
এরপর কাউন্সিলের মাধ্যমে জেলা কমিটি গঠনের মধ্যদিয়ে আহ্বায়ক কমিটির দায়িত্ব শেষ হবে। কিন্তু দুটি জেলা বাদে সবগুলোই কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেছে। নির্ধারিত সময় পার হলেও এখন পর্যন্ত সব পর্যায়ের কমিটি গঠনের কাজ শেষ করতে পারেনি তারা।
নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-গ্রুপিংয়ের মূল কারণ বলে স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন। এসব নিয়ে ক্ষুব্ধ দলটির হাইকমান্ড।
জানা যায়, তৃণমূলকে গতিশীল ও শক্তিশালী করতে সাংগঠনিক জেলাগুলোতে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয় দলটির হাইকমান্ড। অভিযোগ রয়েছে, ঘোষিত আহ্বায়ক কমিটির বেশ কয়েকটি জেলার শীর্ষ নেতারা পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন।
সেখান থেকেই দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলার উপজেলা-থানা-ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি গঠন করছেন; যা স্থানীয় নেতারা ভালোভাবে নিচ্ছেন না।
তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব বা ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়কের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ নিয়ে আর জেলায় যান না নেতারা। তারা ঢাকায় অবস্থান করে স্থানীয় নেতাদের ডেকে এনে কমিটি করছেন।
যে কারণে অধিকাংশ জেলায় তৃণমূলের মতামত উপেক্ষিত হচ্ছে। ত্যাগী, যোগ্য ও পরীক্ষিতরা অনেকেই বাদ পরছেন।
তারা বলেন, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী জেলার আহ্বায়ক কমিটি সংশ্লিষ্ট উপজেলা-থানা-ইউনিয়নে গিয়ে দলীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি করার কথা।
কোনো কারণে যেটা সম্ভব না হলে স্থানীয় নেতাদের মতামত নিয়ে কমিটি ঘোষণা করার কথা। অথচ অধিকাংশ জেলার নেতারা তা করছেন না। যে কারণে এক পক্ষ কমিটি গ্রহণ করলেও আরেক পক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করার মতো ঘটনা ঘটছে।
জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স যুগান্তরকে বলেন, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি- তা বলা যাবে না। মানিকগঞ্জ ও নীলফামারী জেলায় সম্মেলন হয়েছে।
এছাড়া ১৭টির মতো জেলায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে গেছে। ২০১৯ সালের জুন থেকে আমরা সাংগঠনিক পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছিলাম।
এর ৭-৮ মাস পরই তো করোনা শুরু হয়ে গেল। রাজনৈতিক পরিবেশ সে রকম ছিল না, এক জায়গায় বসে যে সম্মেলন করব তারও জায়গা পাওয়া যায় না, প্রশাসন বাধা দেয়।
বিভিন্ন জায়গায় সরকারিভাবে বিধিনিষেধ দিয়ে বিএনপির কর্মকাণ্ড বন্ধ করা হয়েছে। আবার করোনার সময় দুবার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড আমরা স্থগিত করছি।
এখনও স্থগিত আছে। রাজনৈতিক বৈরী পরিবেশ, তারপর করোনা মহামারি- এসব কারণেই কাজগুলো করতে দেরি হচ্ছে।
জানা যায়- পঞ্চগড়, সৈয়দপুর, বগুড়া, নওগাঁ, রাজশাহী জেলা, নাটোর, পাবনা, জয়পুরহাট, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, ময়মনসিংহ মহানগর, ময়মনসিংহ উত্তর ও দক্ষিণ, নেত্রকোনা, গাজীপুর জেলা, নারায়ণগঞ্জ জেলা, রাজবাড়ি, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, সিলেট জেলা, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম মহানগর, চট্টগ্রাম দক্ষিণ ও উত্তর সাংগঠনিক জেলার শাখার আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
যাদের ৩ মাসের মেয়াদ দিলেও তা বহু আগেই শেষ হয়েছে। বিএনপির দুজন ভাইস চেয়ারম্যান জানান, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তৃণমূলকে শক্তিশালী করার উদ্দেশে জেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত দেন।
তিনি থানা-উপজেলা-ইউনিয়নসহ সব পর্যায়ের কমিটির গঠনের জন্য যেসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন তা ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে ভবিষ্যতে যে কোনো দলের জন্য তা মডেল হিসাবে বিবেচিত হতো। অথচ নেতারা পদ নিয়ে আর কাজ করতে চান না।
৩ মাসের মেয়াদ দিলেও অনেক জেলা ২ বছরও পার করেছে। হামলা-মামলা, করোনাসহ নানা অজুহাতে কমিটির মেয়াদ বাড়িয়েছে। তারপরও এখন পর্যন্ত কমিটি গঠনের কাজ শেষ করতে পারেনি।
বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭নং ধারায় বলা আছে, ‘ওয়ার্ড থেকে জেলা/মহানগর কমিটি পর্যন্ত সব কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি নির্বাচিত হবে। এ সময়ের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন সম্ভব না হলে যুক্তিসঙ্গত কারণে ঊর্ধ্বতন কমিটি পরবর্তী ৩ মাসের জন্য সংশ্লিষ্ট কমিটির মেয়াদ বাড়াতে পারবে। এর মধ্যে নতুন কমিটি গঠিত না হলে পূর্ববর্তী কমিটি বাতিল বলে গণ্য হবে এবং ঊর্ধ্বতন কমিটি সংশ্লিষ্ট এলাকায় ৩ মাসের মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনের শর্তে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আহ্বায়ক কমিটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে ব্যর্থ হলে কেন্দ্র থেকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য কমিটি গঠন করে দেওয়া হবে।’
কমিটি গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক নেতা জানান, অন্তত ৭টি জেলার আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব ঢাকায় পরিবারসহ থাকেন। যাদের সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের সেভাবে যোগাযোগ নেই। লক্ষ্মীপুর ও ফরিদপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক জেলায় বহুদিন ধরে কোনো কমিটি নেই। পাবনায় কমিটি হওয়ার পর থেকেই নানা সমস্যা চলছে।
সেখানে এক প্রভাবশালী নেতার অনুসারী নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করতে গিয়ে কমিটি গঠনে লেজেগোবরে অবস্থা করে ফেলেছেন। সাতক্ষীরায় বিএনপির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিবকে কোণঠাসা করার জন্য আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব করা হয়েছে তার বিরোধী পক্ষের লোকজন দিয়ে।
সেখানেও কমিটির গঠনের পর থেকে তেমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই। স্থানীয় দ্বন্দ্বে মাদারীপুরের কমিটি বহু দিন ধরে স্থগিত। নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটিতে চলছে গ্রুপিং। কোনো সভা হলে কমিটির সবাইকে জানানো হয় না। শুধু আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের পছন্দের লোকজন সেখানে আমন্ত্রণ পান। এ রকম হযবরল অবস্থা সব কমিটিতেই রয়েছে। শুধু নীলফামারী ও মানিকগঞ্জে আহ্বায়ক কমিটি কেন্দ্রের নির্দেশ মতো কাজ শেষ করেছে। তারা তৃণমূলের কমিটি দিয়ে সম্মেলনের মাধ্যমে জেলার নেতৃত্ব দিতে পেরেছে।
জানতে চাইলে পাবনা জেলার কমিটির আহ্বায়ক ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, আমার অধীনে থাকা সব কমিটি হয়নি। মাঝখানে করোনা শুরু হলে কমিটি গঠনের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কমিটির মেয়াদ ৩ মাস থাকে। কিন্তু তা ৩ বছর, ১৩ বছরও যায়। আমার অধীনে থাকা বিভিন্ন পর্যায়ের নয়টি কমিটি হয়েছে, অর্থাৎ অর্ধেক হয়ে গেছে। বাকি কমিটি করার ক্ষেত্রে করোনা কবে শেষ হয় দেখি।
ফরিদপুর বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম বলেন, আহ্বায়ক কমিটির উদ্যোগটা পজিটিভ। দল যে টার্গেট নিয়ে করেছিল তা বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে অধিকাংশ জেলা-উপজেলায় প্রোগ্রাম করতে পারছি না। তারপর আবার করোনায় অনেক দিন ধরে কর্মকাণ্ড বন্ধ।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দল থেকে নির্দেশ পেয়েছিলাম, আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব বা ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক হবে এ রকম কেউ লোকালের বাইরে থেকে হবে না। যে আহ্বায়ক হবেন তাকে অবশ্যই জেলায় থাকতে হবে। ওই নির্দেশ অনুসরণ করেই আমরা কমিটি করেছি।
পরেও আমাদের টার্গেট সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যারাই হবেন লোকালকেন্দ্রিক যাতে হয়। সে ব্যাপারে নেতাকর্মীদেরও উৎসাহিত করব। দলের কাছে অনুমতি চাইব ঢাকা থাকে বা এলাকায় স্থায়ীভাবে থাকেন না- এমন কাউকে বিশেষ করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যাতে না করা হয়।লাম