জাতীয় ডেস্ক
সারা দেশে চলমান ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক কর্মবিরতি কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করেছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। শনিবার (৬ ডিসেম্বর) শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ এবং বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আগামী রবিবার (৭ ডিসেম্বর) থেকে সব শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ন্যায্য তিন দফা দাবির প্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন ধরে চলমান আন্দোলন ও কর্মসূচি পালন করা হলেও শিক্ষার্থীদের স্বার্থ, মানবিকতা ও নৈতিকতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পরীক্ষার সময় কর্মবিরতি স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উভয় সংগঠন জানায়, তৃতীয় প্রান্তিক মূল্যায়ন বা বার্ষিক পরীক্ষা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে শিক্ষকরা পূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন।
গত ৩ ডিসেম্বর থেকে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকরা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন শুরু করেন। এই কর্মসূচির ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদান বন্ধ হয়ে যায় এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমেও ধীরগতি দেখা দেয়। শিক্ষকরা জানান, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ১০ নভেম্বর জারিকৃত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তাদের বেতন স্কেল-সংক্রান্ত দাবিতে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ের মধ্যে সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। ফলে দাবি আদায়ে বাধ্য হয়ে তারা কর্মবিরতির পথে হাঁটেন।
শিক্ষকদের তিন দফা দাবির মধ্যে প্রথমটি হলো—সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১০ম গ্রেডে উন্নীত করার দাবির প্রেক্ষাপটে অন্তত ১১তম গ্রেডে প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়টি দ্রুত নিশ্চিত করা। তারা জানান, অর্থ মন্ত্রণালয় ১০ নভেম্বরের বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে নীতিগত সমর্থন দিলেও এখনও আনুষ্ঠানিক প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে বেতন বৈষম্যের শিকার সহকারী শিক্ষকরা হতাশায় ভুগছেন।
দ্বিতীয় দাবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ১০ বছর ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড পাওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রশাসনিক ও কাঠামোগত জটিলতার সমাধান। শিক্ষক সংগঠনগুলোর মতে, বিভিন্ন পর্যায়ে এসব জটিলতার কারণে অনেক শিক্ষক সময়মতো উচ্চতর গ্রেড পান না। এতে পেশাগত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত হন।
তৃতীয় দাবি হলো—সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি নিশ্চিত করা। শিক্ষক সংগঠনগুলোর মতে, প্রাথমিক শিক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করা সত্ত্বেও অনেক সহকারী শিক্ষক পদোন্নতির সুযোগ পান না। প্রশাসনিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতা ও দীর্ঘসূত্রতা এ ব্যাপারে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দেয়। তারা মনে করেন, বিভাগীয় পদোন্নতির সুযোগ বৃদ্ধি পেলে শিক্ষকরা পেশায় আরও উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে পারবেন এবং বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার মানও উন্নত হবে।
কর্মবিরতি স্থগিতের কারণে আগামী রবিবার থেকে সব শ্রেণিতে তৃতীয় প্রান্তিক মূল্যায়ন বা বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ শুরু হবে। শিক্ষক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পরীক্ষাকালীন আর কোনো কর্মসূচি পালন করা হবে না। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর দাবি বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিবেচনায় পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
শিক্ষা প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদি কর্মবিরতির ফলে প্রাথমিক শিক্ষার মান, শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিকতা এবং বার্ষিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি ছিল। কর্মবিরতি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে পরীক্ষার সুষ্ঠু আয়োজনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে শিক্ষকদের তিন দফা দাবি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দ্রুত এবং সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে শিক্ষাবিষয়ক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা এক লাখের বেশি এবং এখানে কর্মরত সহকারী শিক্ষকের সংখ্যা কয়েক লক্ষ। ফলে তাদের যেকোনো আন্দোলন জাতীয় পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সাম্প্রতিক এই কর্মসূচির প্রভাবও সারা দেশে স্পষ্ট ছিল। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান না; বরং দাবি বাস্তবায়নে সরকারের সঙ্গে আলোচনার পথে অগ্রসর হতে চান।
পরিষদ ও সংগঠন ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে, শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়নে যদি ইতিবাচক অগ্রগতি বজায় থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে কোনো কঠোর কর্মসূচির প্রয়োজন হবে না। তবে দাবি বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে পরীক্ষা শেষে পুনরায় কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে সংগঠনগুলো জানিয়েছে।