জাতীয় ডেস্ক
সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ রক্ষা ও টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, মাছ শুধু বাণিজ্যিক পণ্য নয়; দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য খাদ্য নিরাপত্তার একটি মূল উপাদান হিসেবে এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সোমবার (৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও-এ অনুষ্ঠিত ‘সুস্থ সাগর (হেলদি ওশান)’ বিষয়ক ইনসেপশন কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। কর্মশালাটি আয়োজন করে ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস) এবং ওয়ার্ল্ডফিশ।
উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে বলেন, সমুদ্রসম্পদ রক্ষায় কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও মৎস্য অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা একসঙ্গে কাজ করছে। তবে শুধু বাণিজ্যিক লক্ষ্য নয়, খাদ্য নিরাপত্তা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকেও নীতিনির্ধারণের মূলধারা হিসেবে বিবেচনায় আনতে হবে। এর জন্য সামুদ্রিক সম্পদের লাগসই আহরণ, প্রজননকালীন সুরক্ষা, মাছ ধরার নৌযান ও প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণসহ সবখাতে সমন্বিত নীতিনির্ধারণ অপরিহার্য।
তিনি ক্ষতিকর জালের ব্যবহারকে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য প্রধান হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, নিষিদ্ধ ও সূক্ষ্ম জাল ব্যবহার করলে কেবল ছোট মাছ নয়, গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির কিশোর মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীও নিধন হয়। এতে ভবিষ্যতে মাছের প্রাপ্যতা হ্রাস পায় এবং সামুদ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। এসব ঝুঁকি কমাতে বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বঙ্গোপসাগরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে উপদেষ্টা জানান, জাতিসংঘের গবেষণা জাহাজ ড. ফ্রিডৎজফ ন্যান্সেন-এর দীর্ঘমেয়াদি সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, গত সাত বছরে বঙ্গোপসাগরে মাছের প্রাপ্যতা প্রায় ৭৮ শতাংশ কমে গেছে। তিনি বলেন, এ অবস্থার কারণ হিসেবে অতিরিক্ত আহরণ, প্রজননস্থল ধ্বংস, সামুদ্রিক দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় অক্সিজেনের ঘাটতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সামুদ্রিক প্রাণীর জীবনচক্র ব্যাহত করছে। প্লাস্টিক ও কঠিন বর্জ্যের ব্যাপক বিস্তারও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য উদ্বেগজনক হুমকি সৃষ্টি করছে।
যদিও সামগ্রিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, তবুও সাম্প্রতিক গবেষণায় কিছু ইতিবাচক দিকও উঠে এসেছে। উপদেষ্টা জানান, সাম্প্রতিক জরিপে বঙ্গোপসাগরে নতুন আরও ৬৫ প্রজাতির মাছ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি প্রজাতির অস্তিত্ব পৃথিবীর অন্য কোথাও শনাক্ত হয়নি। তিনি বলেন, এসব নতুন তথ্য বাংলাদেশে সামুদ্রিক গবেষণা ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
অতিরিক্ত আহরণ নিয়ন্ত্রণে বিধিনিষেধ প্রয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করে ফরিদা আখতার বলেন, বড় ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজসমূহকে নির্দিষ্ট নিয়ম ও নির্দেশনার আওতায় না আনলে সমুদ্রের সম্পদ সুরক্ষিত রাখা কঠিন হবে। তিনি বলেন, অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরার সুযোগ বন্ধ করতে হবে এবং সব ধরনের জাহাজকে নিবন্ধন, অবস্থান শনাক্তকরণ প্রযুক্তি (ভিএমএস/জিপিএস) ও নির্ধারিত এলাকার নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। এর মাধ্যমে মাছের উৎপাদন পুনরুদ্ধার, প্রজননস্থল রক্ষা এবং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই আহরণ নিশ্চিত করা সম্ভব।
কর্মশালায় দেশের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের বিভিন্ন সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা এবং সম্ভাব্য করণীয় নিয়ে আলোচনা করেন। বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সচিব-ইন-চার্জ) মোহাম্মদ নাভিদ শফিউল্লাহ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কমোডর শেখ মাহমুদুল হাসান এবং মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফ।
বক্তারা বলেন, সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা শুধু একটি খাতভিত্তিক কার্যক্রম নয়; এটি আন্তঃসংস্থাগত সহযোগিতা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, নীতিগত সিদ্ধান্ত ও উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে টেকসই করা সম্ভব। তারা জোর দিয়ে বলেন যে, সাগর ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জেলেদের দক্ষতা বৃদ্ধি, বিকল্প জীবিকার সুযোগ, বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ও আধুনিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় দেশের সামুদ্রিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।
অনুষ্ঠানে ডব্লিউসিএস বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. ফারুক-উল ইসলাম সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং টেকসই আহরণ পদ্ধতি গড়ে তোলার বিষয়ে গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক তথ্য তুলে ধরেন। তারা জানান, বৈজ্ঞানিক তথ্যভিত্তিক নীতি গ্রহণ করলে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা, মৎস্যসম্পদ পুনরুদ্ধার এবং নীল অর্থনীতি–কেন্দ্রিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হবে।
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা আশা প্রকাশ করেন যে, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের সার্বিক পরিবেশগত অবস্থা উন্নত হবে এবং দেশের সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।