অর্থনীতি ডেস্ক
বাংলাদেশের স্বর্ণবাজারে টানা সপ্তমবারের মতো মূল্যবৃদ্ধির পর নতুন সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) সর্বশেষ মূল্য সমন্বয় ঘোষণা করেছে শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) রাতে। নতুন দর অনুযায়ী, ২২ ক্যারেট সোনার প্রতি ভরি ১,৫৭৪ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৭ হাজার ৮৫৬ টাকায়, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এই নতুন মূল্য রবিবার (২৯ ডিসেম্বর) থেকে সারা দেশে কার্যকর হবে।
বাজুসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাজারে তেজাবি বা পিওর গোল্ডের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এই মূল্য সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্বর্ণ আমদানিকারক ও সরবরাহ পর্যায়ে কাঁচা সোনার মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বাজারে প্রতিফলিত হওয়ায় গ্রাহক পর্যায়ে খুচরা দর সমন্বয় করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে দামের অস্থিরতা এবং স্থানীয় চাহিদা-সরবরাহ পরিস্থিতিও মূল্য সমন্বয়ে ভূমিকা রেখেছে।
নতুন সমন্বয়কৃত দর অনুযায়ী, ২১ ক্যারেট সোনার প্রতি ভরি ২ লাখ ১৭ হাজার ৫৩৪ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৮ ক্যারেট সোনার প্রতি ভরি বিক্রি হবে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪৪৯ টাকায় এবং সনাতন পদ্ধতির (প্রচলিত মান, ২২ ক্যারেটের নিচে) সোনার প্রতি ভরি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪২৩ টাকা। অর্থাৎ মানভেদে সব শ্রেণির সোনার দামেই বৃদ্ধি এসেছে, যার প্রভাব পড়বে বিয়েসহ মৌসুমি কেনাকাটায়।
বাংলাদেশে সাধারণত শীত মৌসুমে বিয়ে ও সামাজিক অনুষ্ঠানের চাহিদা বাড়ে, যার ফলে অলংকার সোনার বিক্রি বছরের এই সময়ে তুলনামূলক বেশি থাকে। কিন্তু চলমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্রেতাদের বড় অংশ স্বর্ণ কেনায় কৌশলী আচরণ করছে বলে জানিয়েছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। অনেকে ওজন কমিয়ে, ডিজাইন সরল করে কিংবা পুরোনো সোনা বদল করে নতুন অলংকার সংগ্রহের দিকে ঝুঁকছেন। বাজুসের মূল্য নির্ধারণে মজুরি বা মেকিং চার্জ অন্তর্ভুক্ত না থাকায় অলংকার কেনায় প্রকৃত খরচ আরও বাড়বে।
ঢাকার তাঁতিবাজার, বসুন্ধরা সিটি, চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজার, খুলনার ডাকবাংলো মোড় ও রাজশাহীর সাহেববাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তেজাবি সোনার দাম সরবরাহ পর্যায়ে বাড়ার কারণে খুচরা বাজারে দর সমন্বয় করা ছাড়া বিকল্প ছিল না। তাঁদের মতে, গত দুই মাস ধরে দফায় দফায় দাম বাড়ায় বাজারে একধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। তবে পুরোনো সোনা এক্সচেঞ্জের লেনদেন তুলনামূলক বেড়েছে।
স্বর্ণের পাশাপাশি রুপার দামও রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। নতুন দর অনুযায়ী ২২ ক্যারেট রুপার প্রতি ভরি নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ হাজার ৬৫ টাকা। ২১ ক্যারেট রুপার ভরি বিক্রি হবে ৫ হাজার ৫৭৪ টাকায়, ১৮ ক্যারেট রুপার ভরি ৪ হাজার ৯৫৭ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির রুপার প্রতি ভরি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৭৩২ টাকা। রুপার বাজারে এই মূল্যবৃদ্ধি গহনার পাশাপাশি শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত রুপার কাঁচামালেও প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী স্বর্ণ আমদানি ও বৈধ সরবরাহ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হলেও, স্থানীয় বাজারে তেজাবি সোনার সরবরাহ ও মূল্য কাঠামো অনেকাংশেই আমদানিকারক সিন্ডিকেট ও ডলার বিনিময়দরের ওপর নির্ভরশীল। চলমান সময়ে টাকার বিপরীতে ডলারের দর বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি খরচ বেড়েছে, যা স্বর্ণের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক স্বর্ণবাজারে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, বিনিয়োগ চাহিদা বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে স্বর্ণের দর ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে, যার প্রভাব বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর বাজারে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বড় অংশ সোনাকে নিরাপদ সম্পদ (Safe Haven Asset) হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে শেয়ারবাজার, মুদ্রাবাজার বা ব্যাংক সুদের হারে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে অনেক বিনিয়োগকারী স্বর্ণে পুঁজি স্থানান্তর করেন। এতে স্থানীয় বাজারে বিনিয়োগ-চাহিদা বাড়ে এবং সরবরাহ-সংকটের আশঙ্কায় খুচরা দর আরও চাপে পড়ে। চলমান দফায় মূল্যবৃদ্ধির ধারাবাহিকতাও বিনিয়োগ চাহিদার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবকে প্রতিফলিত করছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
ভোক্তা পর্যায়ে স্বর্ণ কেনাকাটায় কর, মজুরি, ক্যারেটভেদে মান যাচাই এবং হলমার্কিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাজুসের নির্দেশনায় দেশে স্বর্ণ অলংকারে হলমার্কিং বাধ্যতামূলক হলেও, দাম বৃদ্ধির সময় ক্রেতাদের মান যাচাই ও হলমার্কযুক্ত সোনা কেনার প্রবণতা বাড়ে, যাতে ভবিষ্যতে পুনরায় বিক্রি বা এক্সচেঞ্জে মূল্য কম না আসে। তবে দাম বেশি হওয়ায় স্বল্পআয়ের ক্রেতাদের বড় অংশ রুপা বা গোল্ড-প্লেটেড অলংকারের দিকে ঝুঁকছেন, যা বিকল্প গহনার বাজারে নতুন চাহিদা তৈরি করছে।
বাজুস জানিয়েছে, বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখা হবে এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পিওর গোল্ডের মূল্য কাঠামো বিবেচনায় পরবর্তী সমন্বয় ঘোষণা করা হতে পারে। সংগঠনটি মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা বজায় রাখার কথা বললেও, বাজার-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ডলার বিনিময়দর স্থিতিশীল না হলে এবং সরবরাহ কাঠামোতে প্রতিযোগিতা না বাড়লে স্বর্ণের দাম স্বল্পমেয়াদে কমার সম্ভাবনা কম।
গ্রাহক অধিকার বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বর্ণ কেনায় মান যাচাই, হলমার্ক ও মজুরি নিয়ে স্পষ্ট রসিদ সংরক্ষণ করা জরুরি। কারণ দাম বৃদ্ধির সময় খুচরা পর্যায়ে কিছু ক্ষেত্রে মজুরি বা এক্সচেঞ্জ মূল্যে অস্পষ্টতা তৈরি হয়, যা ভবিষ্যতে ক্রেতাদের ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাঁরা বৈধ চ্যানেলে স্বর্ণ কেনা, মান যাচাই করে লেনদেন করা এবং দামের পরিবর্তনের আগে-পরে বাজার যাচাইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন।
দেশের অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, স্বর্ণ ও রুপার মূল্যবৃদ্ধি শুধু গহনা বাজারেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি আমদানি ব্যয়, ডলার রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি, ভোক্তা-ব্যয় আচরণ এবং বিনিয়োগ মনস্তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। ফলে টানা সপ্তমবারের এই মূল্য সমন্বয় দেশের ভোক্তা ও বিনিয়োগ বাজারে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যার ওপর নজর রাখা প্রয়োজন।
শেষ পর্যন্ত, দেশের স্বর্ণবাজারে এই নতুন রেকর্ড ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সংকেত, যা আগামী মৌসুমী কেনাকাটা ও সম্পদ ব্যবস্থাপনায় বড় প্রভাব ফেলবে।