জাতীয় ডেস্ক
ঢাকা, রোববার, ১ ডিসেম্বর: পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ১৬ বছর পর গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে জমা দিয়েছে। আজ রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানসহ অন্যান্য সদস্যরা প্রতিবেদনটি প্রধান উপদেষ্টার হাতে তুলে দেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জাতিকে দীর্ঘ সময় অন্ধকারে রেখেছিল। সত্য উদঘাটনে কমিশনের ভূমিকা জাতির মনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, প্রতিবেদনটি জাতির বহু প্রশ্নের উত্তর দেবে এবং এতে উঠে আসা শিক্ষণীয় বিষয়গুলো দেশের জন্য মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে।
কমিশন প্রধান ফজলুর রহমান জানান, তদন্ত প্রক্রিয়াকে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও ত্রুটিমুক্ত রাখতে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রাখা হয়েছে। ১৬ বছর আগে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ডের অনেক আলামত ধ্বংস হয়ে গেছে, অনেক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বিদেশে অবস্থান করছেন। তবুও কমিশন সাক্ষ্য গ্রহণ করেছে, একেকজনের বক্তব্য আট ঘণ্টা পর্যন্ত শুনেছে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপকরণ সংগ্রহ করেছে।
তদন্তে দেখা গেছে, বিডিআর হত্যাকাণ্ডে বহিঃশক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্টতারও শক্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। কমিশনের সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত ছিল এবং এর প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস। স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা অভিযুক্তদের রক্ষা করতে সরাসরি ভূমিকা নিয়েছিল।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পিলখানায় প্রবেশ করা ছোট মিছিলটি শুরুতে ২০–২৫ জনের ছিল, পরে দুই শতাধিক মানুষ এতে যুক্ত হয়। পুরো ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ছিল। দায় নিরূপণে তৎকালীন সরকারপ্রধান থেকে সেনাপ্রধান পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যকারিতায় ত্রুটি লক্ষ্য করা গেছে।
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর কমিশন রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিআরআইসিএম ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে। ফজলুর রহমান বলেন, তদন্তে দেখা গেছে, ভারত এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করার চেষ্টা করেছিল। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ জানিয়েছিলেন, সেনা অভিযান চালালে ভারত হস্তক্ষেপ করতে পারত।
প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে, যেমন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, মির্জা আজম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাহারা খাতুন, জেনারেল তারেক, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন এবং ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান জেনারেল আকবর। এছাড়া গুম হওয়া পাঁচ সেনা কর্মকর্তার বিষয়ে দেখা গেছে, তাদের ডিজিএফআইতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল; গুম করা হয়নি।
পটভূমি হিসেবে, ২০০৯ সালের ২৫–২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানা সদর দপ্তরে বিডিআর বিদ্রোহের নামে মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৮ সেনা সদস্য নিহত হন। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা দু’বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। তৎকালীন সরকারের সম্মতিতে এবং কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির সহযোগিতায় হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন হয়।
কমিশন ভবিষ্যতে সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সুপারিশ দিয়েছে। অনুষ্ঠানে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী এবং স্বরাষ্ট্র সচিব উপস্থিত ছিলেন।