জাতীয় ডেস্ক
রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তব্য ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচনের প্রাক্কালে কিছু রাজনৈতিক দল ধর্মীয় ইস্যুকে ব্যবহার করে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে এবং এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টির ঝুঁকি রয়েছে।
বুধবার (৩ ডিসেম্বর) ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালুর মাঠে একটি মেডিকেল ক্যাম্প উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এসব মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু ঘিরে দেশের সমসাময়িক পরিস্থিতি ও নির্বাচনকালীন পরিবেশ নিয়ে তিনি মত প্রকাশ করেন।
মির্জা আব্বাস বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা দেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন না, তারা বর্তমানে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় হয়ে ওঠার পাশাপাশি জনগণের কাছে সমর্থন চাইছেন। তার দাবি, এ ধরনের দলগুলো ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে, যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য অনুকূল নয়। তিনি জানান, ধর্মভিত্তিক প্রচার ও ভয়ভীতি সৃষ্টি গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং ভোটারদের স্বাধীন মতামত প্রকাশে প্রভাব ফেলতে পারে।
তিনি আরও বলেন, কিছু রাজনৈতিক নেতা তাদের বক্তব্যে এমন বার্তা দিচ্ছেন যে নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ভোট না দিলে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এ ধরনের বক্তব্যকে তিনি অগণতান্ত্রিক ও অনৈতিক হিসেবে বর্ণনা করেন এবং দাবি করেন যে এতে সমাজে বিভাজন তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মির্জা আব্বাসের মতে, রাজনৈতিক মতভেদ থাকতেই পারে, তবে তা সহিংসতার আশঙ্কা তৈরি বা ধর্মীয় অনুভূতি উস্কে দেওয়ার মাধ্যমে করা যায় না।
বক্তৃতায় তিনি ১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা রাজাকার বা আলবদর হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তার দাবি, এসব গোষ্ঠীর কিছু অংশ এখনও সক্রিয় এবং তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করার চেষ্টা করছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীরা যে বাংলাদেশ চায়নি, সেই দেশের নাগরিকদের কাছেই এখন তারা ভোট চাইছে—যা তিনি রাজনৈতিকভাবে বৈপরীত্যপূর্ণ বলে অভিহিত করেন।
এর পাশাপাশি, তিনি জামায়াতের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে বক্তব্য দেন। তার মন্তব্য অনুযায়ী, দলটি ধর্মীয় ব্যাখ্যার নামে এমন অবস্থান গ্রহণ করে যা তিনি মূলধারার ইসলামী চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করেন না। তিনি বলেন, ধর্মের নামে শুধুমাত্র বাহ্যিক রূপ প্রদর্শন করে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা জনমনে ভুল ধারণা তৈরি করতে পারে এবং সমাজে মতাদর্শগত বিভাজন বাড়াতে পারে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি দেশের সাধারণ ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা রাজনৈতিক প্রলোভন, বিভ্রান্তিকর বক্তব্য বা ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে পরিচালিত প্রচারণার প্রতি সতর্ক থাকে। তিনি উল্লেখ করেন, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা বজায় রাখতে হলে ভোটারদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ থাকতে হবে এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা হতে হবে যুক্তিভিত্তিক ও নীতিগত অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশের নির্বাচনী পরিবেশে ধর্মীয় ইস্যুর ব্যবহার দীর্ঘদিনের একটি বিতর্কিত বিষয়। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে বিভিন্ন দলেই ধর্মীয় আবহ তৈরি করে ভোটারদের সহানুভূতিতে প্রভাব ফেলতে চাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এ ধরনের প্রচারণা কখনও কখনও উত্তেজনা বাড়ায় এবং ভোটারদের বিভক্ত করে। নির্বাচন কমিশন অতীতে একাধিকবার ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক প্রচারণা নিষিদ্ধ করার নির্দেশনা দিয়েছে, যদিও মাঠপর্যায়ে এর প্রয়োগ কঠিন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মত, ধর্মভিত্তিক প্রচার শুধু ভোটারদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে না, বরং দেশের বহুত্ববাদী সামাজিক কাঠামোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। নির্বাচনকালীন সময়ে উত্তেজনাপূর্ণ ভাষ্য, উসকানিমূলক বক্তব্য বা ধর্মীয় ইস্যু ব্যবহার রাজনৈতিক সহিংসতার ঝুঁকিও বাড়াতে পারে। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়ার পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ প্রত্যাশা করেন এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পরকে সম্মানজনক ভাষায় সমালোচনা করার আহ্বান জানান। তাদের মতে, উন্নয়ন, নীতি এবং জনগণের স্বার্থকে কেন্দ্র করে আলোচনাই গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারে।
দীর্ঘ বক্তব্যে মির্জা আব্বাস রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক, শান্তিপূর্ণ ও নীতিনিষ্ঠ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতার স্বার্থে ভোটারদের সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।