জাতীয় ডেস্ক
জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আজমী পার্বত্য চট্টগ্রামের অতীত অস্থিরতা, আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর উত্থান এবং প্রতিবেশী ভারতের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। বুধবার (২ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত ওই অনুষ্ঠানে তিনি ইতিহাসগত প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থানসংক্রান্ত বেশ কিছু দাবি উপস্থাপন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আজমী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘাত দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক ভূরাজনীতির প্রভাবের মধ্যে ছিল। তার দাবি অনুযায়ী, সত্তর দশকের পরবর্তী সময় থেকে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সেখানে অস্থিরতা বৃদ্ধির পেছনে আঞ্চলিক শক্তির ভূমিকা ছিল। তিনি উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেশী দেশের নীতিগত অবস্থানের কারণে প্রভাবিত হয়েছে বলে তার ধারণা।
তিনি আরও দাবি করেন, সশস্ত্র শান্তিবাহিনীর প্রাথমিক দাবি পূরণ না হওয়ায় সংগঠনটি বিদেশি সহায়তার প্রত্যাশায় সীমান্তের বাইরে যোগাযোগ স্থাপন করে। আজমীর বক্তব্য অনুযায়ী, শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ওই প্রচেষ্টায় সাড়া না পাওয়া গেলেও পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর শান্তিবাহিনীকে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হয়। তার ভাষ্য অনুসারে, আশ্রয়, খাদ্য, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সহায়তার মাধ্যমে সংগঠনটি দীর্ঘসময় সক্রিয় থাকার সুযোগ পেয়েছিল।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তি নিয়েও মতামত তুলে ধরেন। তার মতে, চুক্তির মাধ্যমে সশস্ত্র কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়নি এবং অস্ত্রসমর্পণ প্রক্রিয়ায় জমাকৃত অনেক অস্ত্র কার্যকরভাবে অকেজো বা অপ্রয়োজনীয় ছিল। তিনি দাবি করেন, অস্ত্রভাণ্ডারের একটি অংশ গোপন রাখা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে অন্যান্য আঞ্চলিক গোষ্ঠীকে সংগঠিত হতে সহায়তা করে। আজমীর বক্তব্যে উঠে আসে যে, খাগড়াছড়িতে অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানে প্রদত্ত আগ্নেয়াস্ত্রের মান ও কার্যকারিতা নিয়ে তার প্রশ্ন রয়েছে।
তিনি রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্থিতিশীলতার সম্পর্ক নিয়েও মন্তব্য করেন। আজমীর মতে, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকার সময় অঞ্চলটিতে তুলনামূলক স্থিতিশীলতা দেখা যায়, তবে সরকার পরিবর্তনের পর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পুনরায় সক্রিয়তার প্রবণতা দেখা দেয়। তার দাবি, বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক পরিবর্তন সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ডে ভিন্নমাত্রা সৃষ্টি করেছে।
সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তা আরও বলেন, সাম্প্রতিক দশকে পার্বত্য অঞ্চলে সেনা ক্যাম্প পুনর্বিন্যাস ও প্রত্যাহারের ফলে নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে পরিবর্তন এসেছে। তার তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন সময় প্রায় দুই শতাধিক ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন, যা স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর গতিশীলতা বাড়াতে সুযোগ সৃষ্টি করেছে বলে তার ধারণা। তিনি বলেন, পূর্বে যে সমস্ত এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর উপর আক্রমণ কল্পনাতীত ছিল, বর্তমানে সেখানে বিচ্ছিন্ন ঘটনার খবর পাওয়া যায়, যা তার মতে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ বৃদ্ধি করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত এসব বক্তব্য মূলত আজমীর ব্যক্তিগত দাবি হিসেবে উপস্থাপিত হয় এবং তিনি পার্বত্য অঞ্চলের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক উপাদানের প্রভাব তুলে ধরেন। তার বক্তব্যে উল্লেখিত বিষয়গুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস, জাতিগত সম্পর্ক, আঞ্চলিক রাজনীতি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার জটিল বাস্তবতাকে নতুনভাবে আলোচনায় আনে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরে নানা মতাদর্শ, দাবিদাওয়া এবং বাহ্যিক প্রভাবের সংঘাতে সংবেদনশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। ফলে যেকোনো পক্ষের দাবি যাচাই করতে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা, সরকারি নথি এবং বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্যতম জটিল এলাকা, যেখানে জাতিগত বৈচিত্র্য, ভূমি অধিকার, প্রশাসনিক কাঠামো এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা—সবকিছুই ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তি অঞ্চলে একটি রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণের পথ তৈরি করলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় নানা চ্যালেঞ্জ এখনো রয়েছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিভাজন, স্থানীয় দাবি, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এই অঞ্চলে মাঝে মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টি করে থাকে।
আজমীর সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত অভিযোগ ও মন্তব্যগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের নীতিনির্ধারণ, উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়ে নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, এসব দাবি পর্যালোচনা করতে হলে জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা, আঞ্চলিক কূটনীতি এবং শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন অগ্রগতি সমন্বিতভাবে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত বিষয়গুলো নিয়ে সরকারি বা সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থার তাৎক্ষণিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি।